ভাবতে চমত্কার যে একটি টানেলের ভেতর ঢুকবেন আর বেরিয়ে আসবেন করোনামুক্ত হয়ে! কিন্তু ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় কীসের মাধ্যমে তা ঘটবে? আলোড়ন সৃষ্টিকারী জীবানুনাশক টানেলে ব্যবহৃত উপাদানের ব্যবহারবিধি, বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এধরনের উদ্যোগ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত, সর্বোপরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কতার ভিত্তিতে আমরা দেখছি,প্রচেষ্টা মহৎ হলেওপ্রক্রিয়াটি অকার্যকর, বরং তার মাধ্যমে ক্ষতি সাধনের সম্ভাবনা রয়েছে।
রাজধানীর মিরপুর ৬-এ স্থানীয় আদর্শ স্কুলের পাশেই গত ১৪ এপ্রিল একটি জীবাণুনাশক টানেল উদ্বোধন করেছে ‘আর্তনাদ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ১৬ই এপ্রিল প্রথম আলো এই উদ্যোগের ওপর একটি ভিডিও প্রকাশ করলে তা ব্যপক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলাভিশন চ্যানেল-ও এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করে।
আর্তনাদের ফেইসবুক পেইজে দেখা যায় শ্রমিকের মজুরি, কেমিক্যাল, বিদ্যুত এবং আনুষঙ্গিক খরচ বাদেই এতে “সম্ভাব্য” ৩৫-৪০,০০০ টাকা খরচ হয়েছে। তারা বলছেন অজস্র মানুষ তাদের কাছে এধরণের টানেল তৈরী করতে কত খরচ হয় তা জানতে চেয়েছেন। শীঘ্রই আরেকটি মডেল তৈরী করে তারা খরচের বিষয়ে সবাইকে সুনিশ্চিত তথ্য দেবেন। ফেইসবুক পেইজে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে “বেলজিয়াম থেকে আনা পরীক্ষিত কেমিক্যাল” ব্যবহার করেছেন তারা।
প্রথম আলোর ভিডিও থেকে জানা যায়, জীবাণুনাশক এই টানেলে রয়েছে দুইটি লেজার সেন্সর ও দুটি স্প্রেয়ার। এই টানেলের ভেতর দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে সেই ব্যাক্তির শরীরে লেজার সেন্সরের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবাণুনাশক ঝরে পড়ে। ভেতর দিয়ে যাবার সময় প্রত্যেককে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরপাক খেতে হয়। বিশ লিটারের প্রতি ট্যাংক জীবাণু নাশক ২৫০ জনের মতো মানুষের জন্য কাজ করে। কিন্তু সেই জীবাণু নাশকের নাম বা তা কোন মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে তা জানা যায় না।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ১৬ই এপ্রিল মানুষের শরীরে সরাসরি জীবাণুনাশক ছেটানোর সকল কার্যক্রম বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সকল সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দিয়েছে। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার এই নির্দেশে উল্লেখ করা হয়েছে যে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে এধরণের কাজে জীবাণুনাশক হিসেবে ব্লিচিং পাউডার (হাইপোক্লোরাইড) এর দ্রবণ ব্যবহার করা হচ্ছে যা মানবদেহের উন্মুক্ত বহিঃ অঙ্গসহ চোখ মুখের জন্য ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর নির্দেশনা অনুযায়ী এটি বিধিবদ্ধ নয়।
ফ্যাক্টওয়াচ প্রতিনিধি আর্তনাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা সহযোগিতা করেন। বেলজিয়াম থেকে আনা কী সেই পরীক্ষিত কেমিক্যাল তা জানতে চাইলে তারা জানান জীবানুনাশক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে; “Ammonia (Alkyldiemethylbenzylammonium chloride, Didecyldimethylammonium chloride) Aldehyde (Glutaraldehyde), Isopropanol Alcohol, Pine oil।’ সরকারী নির্দেশে যে হাইপোক্লোরাইড দ্রবণের কথা বলা হয়েছে, তা তারা ব্যবহার করছেন না।
তারা প্রথম যে দুটি কোয়াটারনারি এমোনিয়াম ভিত্তিক রাসায়নিক জীবাণুনাশকের কথা বলেছেন তা নির্দিষ্ট মাত্রায় জিনিসের পৃষ্ঠতলকে করোনাভাইরাসমুক্ত করতে কার্যকর কিন্তু মানবদেহে সরাসরি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিপদজনক, বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্র এবং প্রজননতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকারক। এজমা এবং এলার্জির ঝুঁকিও রয়েছে ।
গ্লুটারেলডিহাইড হাসপাতালে সার্জারির সরঞ্জাম জীবানুমুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়, রোগীর শরীরে নয় । অতিমাত্রায় এর ব্যবহারে ত্বকের জ্বালাপোড়া, বমি, মাথাব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট তৈরী হতে পারে।
আইসোপ্রপিল এলকোহল, যা রাবিং এলকোহল হিসেবে ত্বকের ছোটখাটো কাঁটাছেড়ায় জীবাণুনাশক ব্যবহৃত হয়, তাও নাক বা মুখ দিয়ে প্রবেশ করলে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে।
পাইন অয়েল-ও ঘরবাড়ি ধোয়ামোছার ক্ষেত্রে সুপ্রচলিত একটি পরিষ্কারক এবং বালাইনাশক। ভাইরাস নিধনে এর কোন কার্যকারিতা নেই। মানুষর দেহের ওপর সরাসরি ব্যবহারেরও নজির নেই।
আর্তনাদের উল্লিখিত প্রথম দুইটি উপাদান বাদে কোনটিই করোনাভাইরাস নির্মূল করতে কার্যকর বলে জানা যায় না। উপরন্তু, সব কয়টি উপাদানই জিনিসপত্র বা ঘরবাড়ি পরিস্কারের কাজে ব্যবহার্য এবং বিভিন্ন মাত্রায় দেহের জন্য বিষাক্ত বা ক্ষতিকর। মানুষের গায়ে সরাসরি তা ছেটানোর প্রশ্নই ওঠে না।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও শুরুতে এমন জীবাণুনাশক টানেলের ব্যবহার শুরু হলেও সম্প্রতি তামিলনাড়ু এবং পাঞ্জাবসহ বেশ কিছু রাজ্যে এই টানেল গুলোর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভারতের পিজিআইএমইআর এর কোভিড -১৯ প্রতিরোধ ও আইইসি কমিটির চেয়ারম্যান ডক্টর জে এস ঠাকুর বলেছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাজার এবং অফিসের মতো ভিড়ের জায়গাগুলোতে এই জীবাণুনাশক টানেল স্থাপন করা হয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিলো যে এগুলো জীবাণুনাশক হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু এটি স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এধরণের জীবাণুনাশক ছিটানো বিষয়ে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মহাপরিচালক ডাঃ নূর হিশাম আবদুল্লাহ বলেছেন, ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের সময়কালে এই জীবাণুনাশক প্রয়োগ জীবাণুমুক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। প্রক্রিয়াটি মানবদেহের মধ্যে থাকা ভাইরাসকেও দূর করতে পারে না, বরং চোখ এবং মুখের ক্ষতি করতে পারে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের একজন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এধরণের গণ-জীবানুনাশন চিত্তাকর্ষক এবং উদ্দীপক হলেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে অকার্যকর: “এর চাইতে জলকামান দেগে মানুষকে বাড়িতে পাঠাতে পারলেই বরং লাভ হতে পারে।”
করোনাইভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে নানা প্রতিষেধক এবং ঔষধ আবিষ্কারের জন্য বিশ্বব্যাপী চলছে নিরন্তর গবেষণা, কোনো চেষ্টাতেই যেন কমতি নেই কোথাও। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল ।এধরণের উদ্যোগের পেছনের উদ্দেশ্য মহান তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে আদৌ কোন উপকার হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক। বরং এতে অনাকাংক্ষিত ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায় আর্তনাদ শহরের বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় আরও জীবানুনাশক টানেল তৈরির আশা রাখে। আমরা মনে করি তার আগে এর কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা তাদের কর্তব্য।