ফ্যাক্ট-চেকাররা যেকোনো তথ্য যাচাই কিংবা সত্য উদঘাটনের জন্য কোনো দাবী আমলে নেবার আগে নিজেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন:
১) এটা কি গুরুত্বপূর্ণ?
২) এটি কি যাচাইযোগ্য?
প্রথম প্রশ্নটি কিছুটা সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত। কেননা অগণিত তথ্য নিয়ে কাজ করার মতন সময় আমাদের কম এবং সবসময় সমস্ত দাবীর সত্যতা যাচাই করা যায় না। এক্ষেত্রে দাবীগুলো যাচাই বাছাইয়ের সহায়তার জন্য একটি দর্শন থাকা সহায়ক হয়। যেমন কোনো ফ্যাক্ট চেককারী প্রতিষ্ঠান হয়তোবা তথ্য যাচাইয়ের জন্য জোর দেয় রাজনীতিবিদদের বক্তব্যের ওপর, যে সেউ বক্তব্যের তথ্য যাচাই করার যোগ্য কিনা। অপরদিকে আরেকটি প্রতিষ্ঠান হয়তো সেই বক্তব্যটিকে শুধুই ‘মন্তব্য’ কিংবা ‘রাজনৈতিক প্রচারণা’ হিসেবে দেখতে পারে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাক্ট-চেকাররা শুরুতে অনেকগুলো দাবীর একটি দীর্ঘ তালিকা এবং তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করতে বসেন, কিন্তু কাজের মাঝ পথে তাকে থেমে যেতে হয়। কারণ প্রায়শই দাবী বা অভিযোগ সমর্থন বা খণ্ডন করার মতো শক্ত প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
বেশীরভাগ সময় জনসাধারণের দাবীগুলো নিছক ধারণা কিংবা মতামত নির্ভর হয় যা যাচাইযোগ্য নয়। তবে এমন অনেকগুলো বক্তব্যও রয়েছে যা সত্য এবং মতামতের মাঝামাঝি অবস্থান করে। নীচে কিছু উদাহরণ দেয়া হলোঃ
১) “আমি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে চার মাসে বেকারত্বের হার দুই দশমিক কমেছে।”
২) “আমার সরকারের প্রতি বেসরকারী খাতের আস্থার কারণে বেকারত্বের হার ২ দশমিক হ্রাস পেয়েছে।”
৩) “আমার সরকার না থাকলে, আজকে আমরা বেকারত্বের হার দুই দশমিক কমে যেতে দেখতাম না।”
উপরের তিনটি বাক্যে একটি তথ্য বারবার বলা হয়েছে যে চার মাসে বেকারত্বের হার দুই দশমিক কমেছে। এটি একটি জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব। দ্বিতীয় দাবীতে বলা হচ্ছে, সরকারের প্রতি বেসরকারী খাতের আস্থার কারণে বেকারত্ব হ্রাস পেয়েছে। এই বিষয়টি বেশ জটিল, কেননা বেশীরভাগ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলির উপর আস্থা রাখার বিষয়ে পরামর্শ দেয়। আবার অন্যদিকে বেকারত্বের হার বিভিন্নভাবে কমতে পারে। যেমন কর্মসংস্থানের তুলনায় চাকরি প্রার্থী কম অথবা অনেক লোক শ্রমবাজার ছেড়ে যাওয়ার কারণে বেকারত্বের হার কমতে পারে। তাছাড়া এই কর্মসংস্থান সরকারী নাকি বেসরকারী খাতে তৈরি হয়েছে সেই তথ্য পরিসংখ্যানের মাধ্যমে শনাক্ত করা বেশ জটিলতর।
আর তৃতীয় দাবীটি স্পষ্টতই একটি মতামত। দেশ অন্য কারও দ্বারা পরিচালিত হলে বেকারত্বের হারের কী হত তা জানার আসলে কোনো উপায় নেই। একটি ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে, এই ধরণের দাবী কোনো নির্দিষ্ট তথ্যনির্ভর নয়, তাই বক্তাকে মিথ্যাবাদীও বলা যাবে না।
তথ্যের উৎস মূল্যায়ন
প্রতিটি তথ্যের এক বা একাধিক উৎস থাকে। উৎস চিহ্নিত করতে পারলে তথ্য যাচাই, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন সহজ হয়। উৎসের মাধ্যমে তথ্যদাতার পরিচয়, তার তথ্যের সম্ভাব্য ভোক্তা কারা, তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য কি এবং তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
তথ্যের প্রাথমিক উত্সের ৫টি বৈশিষ্ট্য :
১) এটি প্রাথমিক সাক্ষ্য বা সরাসরি প্রমাণ সরবরাহ করে।
২) এটি এমন কারও দ্বারা তৈরি যিনি/যারা ঘটনাস্থলে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। এটি হতে পারে সেই ব্যক্তির হাতের লিখিত তথ্য অথবা ক্যামেরা দ্বারা তোলা ছবি, ভিডিও।
৩) এটি হতে পারে কারও আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণ অথবা মৌখিক ইতিহাস যা রেকর্ড করে প্রকাশিত হয়েছে।
৪) এটি কোনও পরীক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা কিংবা একাডেমিক অধ্যয়নের ফলাফল থেকে আসতে পারে।
৫) অনেক সময় তথ্য কোনো নির্দিষ্ট বিন্যাসে না থেকে বিচ্ছিন্নভাবে থাকে। যেমন ছোট্ট একটি ভিডিও ক্লিপ, একটুকরো কাগজে কিছু লেখা, কিংবা এলোমেলো ভাবে তোলা কোনো ছবি বা নিজের অজান্তেই রেকর্ড করা কোনো শব্দ। অনেকক্ষেত্রে একটি ঘটনার কোনো পোস্টার বা পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর, যে ঘটনার কোনো প্রতক্ষ্যদর্শী জীবিত নেই, বা মূল ঘটনার ধারণকৃত কোনো ছবি নেই।
নির্ভরযোগ্য উত্স সন্ধান করা
আমরা সাধারণত কোনো তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করি যদি সেটি কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে আসে। আর ফ্যাক্ট চেকারদের সফলতাও নির্ভর করে নির্ভরযোগ্য উৎসের ভিত্তিতে। একজন ফ্যাক্ট চেকারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের জায়গাটি হচ্ছে সেই নির্ভিরযোগ্য ফ্যাক্টের সন্ধান করা। একটি তথ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কিভাবে জানবো সেটির উৎস আসলে নির্ভরযোগ্য কিনা?
এর আগে আমরা জেনেছি কিভাবে তথ্যের মূল উত্সগুলো চিহ্নিত করা যায়। এখন দেখবো কিভাবে ৫ টি প্রশ্নের মাধ্যমে তথ্য, তথ্যের উত্স এবং প্রতিবেদনের পেছনের সংগঠন সম্পর্কে জানা যায় –
১) সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা কে এবং অর্থায়ন করেছে কে? কেন? তাদের পটভূমি কি? যদি পরিচালনা পর্ষদ থাকে তবে সেখানে কে কে আছে? তারা কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে?
২) সংগঠনটি কি অলাভজনক এবং নির্দলীয়?
৩) ‘আমাদের সম্পর্কে’ নামক যে বিভাগটি রয়েছে তাদের ওয়েবসাইট অথবা প্রচারপত্রে সেটা পরীক্ষা করুন। এটা কি পক্ষপাতদুষ্ট? এটি কি কোনো একটি নির্দিষ্ট ‘পক্ষ’ বা ‘দল’কে সমর্থন করে? যদি কোনও ‘আমাদের সম্পর্কে’ অংশটি না থাকে তবে আপনার সন্দেহ হওয়া উচিত।
৪) আপনার তথ্য যাচাইইয়ের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া সংবাদ দাতা ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান কি গ্রহণযোগ্য? এক্ষেত্রের অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা কি এই উত্সটি উদ্ধৃত/ব্যবহার করেছেন?
৫) এই উত্সগুলো তাদের প্রকাশিত তথ্যের উপসংহার কিভাবে টেনেছে? তাদের উপস্থাপিত তথ্যের স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা কতটুকু?
তথ্যের উৎস মূল্যায়নের জন্য কিছু প্রশ্নের সমন্বয়ে একটি ছক তৈরি করুন
প্রাসঙ্গিকতা: প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়বস্তু কতটুকু প্রাসঙ্গিক? যেমনঃ বাংলাদেশের করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই বিভিন্ন অপ-চিকিৎসা ও প্রতিষেধক বের হবার গুজব ছড়িয়ে পরে, মানুষ যখন আতংকিত তখন ভুল-শুদ্ধ বিচারশক্তি অনেকটা লোপ পায়। তাই সময় একটি বড় বিষয় ফ্যাক্ট চেকের জন্য।
বিশেষজ্ঞ: এটি তথ্যদাতার কর্মক্ষেত্র এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার দক্ষতাকে ইঙ্গিত করে। উদাহরণ: তথ্যদাতা একটি বইয়ের লেখক। তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি করেছেন এবং তাঁর ক্ষেত্রের অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে সেটি উদ্ধৃত করেছেন।
তীব্রতা: কীভাবে প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছিল? উদাহরণ: মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার তথ্য প্রায়শই সমীক্ষার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে নারীদের প্রতিক্রিয়া জানানোর আগ্রহ এবং যৌন হয়রানির সংজ্ঞা দেশ-বিদেশে পৃথক হয়ে থাকে।
স্বচ্ছতা: তথ্য-প্রমাণ সম্পর্কে আপনি কী জানেন? উদাহরণ: একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এবং অন্যান্য গবেষকদের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ হয়, তাই এরকম গবেষণামূলক তথ্যের ওপর নির্ভর করা যায়।
নির্ভরযোগ্যতা: তথ্যটি মূল্যায়নের জন্য কি পূর্বে সংরক্ষিত কোনো তথ্য রয়েছে? উদাহরণ: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্নীতি অনুধাবন সূচি প্রকাশ করে আসছে।
আগ্রহের সাথে দ্বন্দ্ব: প্রাপ্ত তথ্যে কি তথ্যদাতার ব্যক্তিগত লক্ষ্য বা আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে?
উদাহরণ: পত্রিকার মতামত কলামে যখন কোনো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক তার নির্দেশিত ঔষধকেই কোনো রোগের একমাত্র প্রতিকার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন।
কিভাবে একটি ভুয়া খবর শনাক্ত করবো?
‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবর হলো সেই ধরণের খবর যা সাজানো, বানোয়াট যা কোনো যাচাইযোগ্য তথ্য, উত্স এবং উদ্ধৃতিহীন। মোবাইল ফোন এবং ইন্টার্নেট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় এই ভুয়া খবর ছড়িয়ে পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে। এই ভুয়া সংবাদ সাধারণত অল্প পরিচিত উত্স থেকে প্রকাশিত হয় যেমন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর অনলাইন সংবাদ-মাধ্যম। তবে আশ্চর্য্য হলেও সত্যি এগুলোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বড় আকারের দর্শক এবং পাঠক অর্জন করে। যদিও ইদানীং কালে প্রথম সারির সংবাদ সংস্থাকেও ভুয়া খবর প্রচারে দেখা গিয়েছে। ভুয়া খবর শনাক্তেরও রয়েছে বেশ কিছু পদ্ধতি।
১) কোনো ছবির অপব্যবহার হচ্ছে কিনা তা শনাক্ত করার একটি সহজ উপায় হলো একই ছবিটি অনত্র অনুসন্ধান করা। সাধারণত আমরা বিভিন্ন শব্দের (কীওয়ার্ড) মাধ্যমে ইন্টার্নেটে কিছু খুঁজি, তবে ভুয়া ছবি বা ছবির প্রথম উৎস ও তা প্রকাশের সময় সম্পর্কে জানতে সেই ছবিটি ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করা যায়। এর মাধ্যমে এই একই ছবিটি বিগত দিনে কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হয়েছিল তা জানা যায়। Google Reverse Image Search ছবি খুঁজার একটি জনপ্রিয় মাধ্যম।
২) যাচাই বিশেষজ্ঞ বা ফ্যাক্ট-চেকারদের কাছে জনপ্রিয় আরেকটি সরঞ্জাম যা সাধারণ জনগণ সহজেই সহজেই ব্যবহার করতে পারেন তা হলো Goodle Earth (গুগল আর্থ)। এটি স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে এবং এটি আপনাকে যেকোনো ছবির স্থানগুলো আসল কিনা তা বুঝতে সহায়তা করে। বিশেষ প্রয়োজনে, গুগল আর্থ কোনো জায়গার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণমূলক সহায়তাও দিয়ে থাকে।
৩) Suncalc বা Wolfram এর মতন সরঞ্জামগুলো আপনাকে আবহাওয়া এবং সূর্যের অবস্থানের আগাম তথ্য দিয়ে থাকে।