“যেখানে ৯২% মুসলিম সেখানে একটা মুসলমান মেয়েকে, নার্সকে দিয়ে শুরু করাতে পারলাম না”- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই বক্তব্য কি সাম্প্রদায়িক?

23
“যেখানে ৯২% মুসলিম সেখানে একটা মুসলমান মেয়েকে, নার্সকে দিয়ে শুরু করাতে পারলাম না”- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই বক্তব্য কি সাম্প্রদায়িক?
“যেখানে ৯২% মুসলিম সেখানে একটা মুসলমান মেয়েকে, নার্সকে দিয়ে শুরু করাতে পারলাম না”- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই বক্তব্য কি সাম্প্রদায়িক?

Published on: [post_published] 

২৭শে জানুয়ারি বুধবার বিকাল চারটার কিছু পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালের নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় বাংলাদেশের করোনাভাইরাস টিকাদান কর্মসূচির। সেদিন রাতে ডিবিসির সরাসরি সম্প্রচারিত ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একটি মন্তব্যকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা। অনেকেই মনে করছেন তার বক্তব্যটি সাম্প্রদায়িক। অন্যরা এটির দ্ব্যর্থকতা কিংবা অস্পষ্টতার কথা বলছেন, দাবি করছেন তিনি টিকা নিয়ে বিদ্যমান কুসংস্কারকে তুলে  ধরতেই একথা বলেছেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আসলে কী বলেছিলেন লাইভে?

রাজকাহনের ‘টিকা নিয়ে এ কেমন রাজনীতি’ শিরোনামের এই পর্বে ডিবিসির শারমিন চৌধুরী অনুষ্ঠানের প্রথম প্রশ্ন হিসেবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে জানতে চান এই টিকা কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করার মত কিছু আছে কি না।

শারমিন চৌধুরি : 

আজকে উদ্বোধন করা হল টিকা কার্যক্রম, দেখে কেমন মনে হল এ শুরুটা? কারণ আজ প্রধানমন্ত্রীও বলছিলেন যে – একরকম খুনসুটি করেই সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন যে, একটা রোগ আছে, “কিছুই ভাল লাগে নাএখানে কি ভাল না লাগার মত কিছু আছে? সমালোচনা করার মত এখানেও কি  কিছু দেখছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী?”

উত্তরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন,

টিকা শুরু হয়েছে, ভালো, অভিনন্দন সবাইকে। তবে সব কিছুতে একটু অন্যভাবে জিনিস দেখা যায়। আমাদের নার্স কস্তাকে ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটা আরেকটা জিনিস এখন বুঝায়, আমাদের মনে কিছুটা কুসংস্কার কিছুটা রয়ে গেছেযেখানে ৯২% মুসলিম সেখানে একটা মুসলমান মেয়েকে, নার্সকে দিয়ে শুরু করাতে পারলাম না। এটা এক হিসেবে, একটুতো…

তবে, এই টিকার ব্যপারে, এটা নিরাপদ, আমি বলব। কালকেও আমি এক জায়গায় বলেছি। আমার নাম আসার সাথে সাথে আমি টিকা নিয়ে নিব। তো এটা নিয়ে ভয়ভীতির  কিছু নাই। সামান্য কিছু সাইড ইফেক্ট সব ঔষধে আছে, ঔটাতেও থাকতে পরে, তবে ভীতিকর কিছুই না। এটা ভাল যাত্রা হয়েছে, এটা শুরু, আমরা সবাই যেন এ টিকাগুলি পাই, টিকাগুলি নেই। 

এটাকে আমরা অনেক ভালভাবে অনেক বেশি আনতে পারব। এটাকে অবজারভ করা, কারো যদি কোন ছোটখাট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, ভয় না পেয়ে ওটা সরকারকে জানানোই ঠিক হবে। সরকারকে এটা বিষয়ে গবেষণাটাকে একটু বাড়িয়ে নেয়ার জন্যআমার একটা প্রস্তাব হল যে এটাকে এপিডেমিওলজিস্টদের আরও বেশি সংখ্যায়, মানে মেডিক্যাল বিজ্ঞানীদেরকে বেশি সংখ্যায় অবজারভেশনে যুক্ত করা। 

দ্বিতীয়ত আরেকটা ভাল খবর আছে আমার কাছে, আগে যেটা আমি বারে বারে বলছিলাম যে বেসরকারি খাতে টিকা শুরু করাটা ঠিক কাজ হবে না। গতকাল তো আমি দেখলাম বেক্সিমকো প্রধান বলেছেন উনারা আনছেন না। এটা যদি সঠিক হয়, আমি খুবই খুশি এবং এটা দেশের জন্য ভাল৷ এ টিকা বাইরে চুরি হবে না, সরকারকে ধন্যবাদ।

এরপর শারমিন চৌধুরি তাকে জিজ্ঞেস করেন টিকার সাথে ধর্মের সম্পর্ক কোথায় –

শারমিন চৌধুরি: 

একটা কুসংস্কার – টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্ম কিভাবে একটা ব্যপার কী করে হয়ে উঠতে পারে? এখানে আসলে কুসংস্কার কেন বলছি?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেন,

এটা এখানে কেন, বিলাতের মতো জায়গাতেও আছে। এটা হালাল না হারাম এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ।

শারমিন চৌধুরি :

তারপর তো আমরা দেখেছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা নিয়েছেন। সেনাবাহিনী ব্রিগেডিয়ারসহ ২৬ জন নিয়েছেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী:

আমার মতে মেয়েদের উপর দিয়েই অত্যাচার।এতোগুলি পুরুষ মানুষ আছি! আমাদের ডিজি সাহেব নিতে পারলেন না? আমাদের যদি মহিলাই নিতে হবে তো আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে নিলে ভাল হত না? উনিতো নিজে একজন ডাক্তারও। আমি সেটা বলছি না, আমি যে কথাটা বুঝতে চেয়েছি, যেখানে কস্তা নিল, সেখানে একটা মুসলিমা নারী নিলে বোধয় জিনিসটা আরও ভাল লাগততবে আমি কস্তাকে ধন্যবাদ জানাই। অভিনন্দন জানাই।

তার বক্তব্য নিয়ে কীভাবে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মন্তব্যের অংশবিশেষ ফেইসবুকে অনেকেই শেয়ার করেছেন , যার বিভিন্ন উদাহরণ দেখুন নিচের ছবিতে। একটি একাউন্ট থেকে বলা হয়েছে:

” ….একজন অমুসলিম মহিলাকে প্রথম ভ্যাকসিন না দিয়ে একজন মুসলিমকে প্রথম ভ্যাকসিন দিয়ে উদ্বোধন করা উচিৎ ছিলো।” – ডা: জাফর উল্লাহ চৌধুরী। (ডিবিসির আলোচনায়।)

ধিক্কার ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী!

বামদের পচন ধরলে এতো কুৎসিত, এতো ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক হয় জানতাম না।

এই স্ট্যাটাসটির বেশিরভাগ কমেন্টে  ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তীব্র সমালোচনা দেখা যাচ্ছে: “সস্তা মানসিকতা”, “পাগল”, “পচা আলু ,“ “মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়,” “একটা পঁচা গান্ডা মাল সব জায়গায় ধর্ম  খুঁজে”, “ধিক্কার ওই সব ডা: দের যারা মানুষ এর মধ্যে পার্থক্য খুঁজে”।

Omar Arif Shimon লিখেছেন, “এই লোকটা সরকারের সাথে করোনার করোনাভাইরাস পরীক্ষা কিট নিয়ে ব্যবসা করতে পারে নাই , অনেক টাকা ধরা খাইছিল। তাই সরকারের যেকোন ভাল কাজকেই খারাপ বলতে হবে। এটা যদি ধর্ম ব্যবহার করা যায় তাহলে পাবলিক আরো ভাল খাবে।”

Juned Khan-এর মনে হয়েছে, “জানতাম মানুষের বয়স বাড়লে সৃতি শক্তি লোপ পায়, কানে‌ কম শুনে , চোখে কম দেখে , কিন্তু মানুষের বয়স বাড়লে হিংসুক ও সাম্প্রদায়িক মন ভাবা সম্পন্ন হয়ে যায় এমন খবর আমার জানামতে নেই ও এমন আজব ঘটনা ঘটতেও দেখিনি ও শুনিনি । … ডা‌‌. জাফরুল্লাহ প্রমান করলেন তিনি সাম্প্রদায়িক দল বিএনপির যথার্থ উপদেষ্টা ও জঘন্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গি র একজন মানুষ।”

লক্ষণীয়, তিনি কুসংস্কার বিষয়ে যা বলেছেন, এখানে সেই অংশ বাদ দিয়ে তাকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। তার দীর্ঘ বক্তব্যের প্রেক্ষাপট এবং বিস্তারিত বিবরণ ছাড়াই সবচাইতে চাঞ্চল্যকর অংশটি শেয়ার হচ্ছে।

তবে সমালোচিত উক্তিটির যে ভিন্ন ভিন্ন তর্জমার সুযোগ রয়েছে সেই আভাস এসেছে এই একই পোস্ট-এর  কমেন্টে। Badiuddin Nazir লিখেছেন, “জাফরুল্লাহ ভাই যা ইঙ্গিত করতে চাইছেন তা খানিকটা বুঝা যাচ্ছে, খানিকটা বুঝা যাচ্ছে না। মাঝখান থেকে সম্প্রদায়িকের স্থায়ী তকমা ললাটে জুটলো। তার এই বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত।…”

Nishat Jahan লিখেছেন, “এমন তো হতে পারে, তিনি হয়তবা ভেবেছিলেন একটি মুসলিম প্রধান দেশে যদি প্রথমেই একজন মুসলিম টিকা গ্রহণ করে তাহলে অন্য মুসলিমরাও কিছুটা ভয়হীন  ভাবে টিকা গ্রহণে আগ্রহী হবে।”

গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ তার একাউন্ট থেকে এই বিষয়ে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন। তিনি মনে করেন যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে জাফরুল্লাহ চৌধুরী মূলতঃ  “সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মাঝে টিকা বিষয়ে কুসংস্কার কাজ করছে, তারা টিকাকে নিরাপদ বলে ভাবছেন না বলে তাদের কেউ সবার আগে টিকা নেয়ার সাহস দেখায়নি।”

গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদের পোস্ট :

ফ্যাক্ট ওয়াচের সিদ্ধান্ত 

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কী অর্থে তার বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত এবং ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তার বক্তব্যের সবচাইতে চাঞ্চল্যকর অংশটিকে প্রেক্ষাপট এবং বিস্তারিত বিবরণ ছাড়া, বিশেষত কুসংস্কার বিষয়ক বাক্যটিকে বাদ দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সেটিকে একপেশে ভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে।

অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে প্রথম টিকা মুসলিম নারীকে দিলে আরও কেন ভালো হত, তার এই বক্তব্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে । একজন নারীকে প্রথম টিকা না দিয়ে পুরুষকে দেয়া সমীচীন ছিল, এই বক্তব্য নিয়েও সমালোচনা করা সম্ভব।

তাকে যখন শারমিন চৌধুরী দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেন যে টিকার সাথে ধর্মের সম্পর্ক কোথায়, তখন ব্রিটেনে টিকার হালাল/হারাম বিতর্কের উদাহরণ ইঙ্গিত করে যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ব্যক্তিগত মতামত যা-ই হোক না কেন, জনমানসে সবসময়েই ধর্ম প্রাসঙ্গিক। তিনি বরং শুরুতেই ধর্মের সাথে কুসংস্কারের সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত ধরেছেন।

ফ্যাক্ট ওয়াচের পক্ষ থেকে পাঠকের জন্য তাঁর বক্তব্য প্রেক্ষাপট সহ অবিকল তুলে ধরা হল, কিন্তু বক্তব্যটি সাম্প্রদায়িক কি না তা প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

ডিবিসির লাইভ অনুষ্ঠানটি দেখুন এখানে (৫৬ সেকেন্ড থেকে ৪ মিনিট ২০ সেকেন্ড)

তথ্যসূত্র
ফেইসবুকের লিংকগুলো দেখুন এখানে এখানেএখানে

ডিবিসির লাইভ অনুষ্ঠান

 

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@www.fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab

No Factcheck schema data available.