ইতালি সংবাদদাতার বরাত দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ২৫ জুলাই সংখ্যায় সংবাদ ছাপা হয়েছে যে, লিবিয়া ও তিউনিশিয়া উপকূল থেকে বাংলাদেশিসহ প্রায় দেড়শতাধিক অভিবাসী উদ্ধার করা হয়। পত্রিকাটি লিখেছে, গত সপ্তাহে ভূ-মধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূল থেকে দুটি নৌকায় করে বাংলাদেশ, ঘানা, নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রায় দেড়শতাধিক অভিবাসী ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, এবং ইতালির সীমানায় প্রবেশ করলে ‘এসওএস মেডিটেরানি’ নামের ইউরোপিয়ান সংস্থার পরিচালিত টহলরত জাহাজ তাদের উদ্ধার করে।
ফ্যাক্টওয়াচের বিশ্লেষণে এই সংবাদটি মনগড়া এবং বিভ্রান্তিকর।
প্রথমত, ‘এসওএস মেডিটেরানি’ নামের এই ইউরোপিয়ান সংস্থাটির লিবিয়া ও তিউনিশিয়া উপকূলে নতুন কোন অভিযানের তথ্য পাওয়া যায়নি। চারটি পৃথক অভিযানে ‘ওশান ভাইকিং’ জাহাজে অভিবাসীদের উদ্ধার করা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেটা ২৫শে জুন থেকে ৩০সে জুনের মধ্যে এবং পরবর্তীতে ইতালিয়ান সামুদ্রিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে উদ্ধারকৃত ১৮০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য ৭ই জুলাই সিসিলিতে নামিয়ে নেয়া হয়।
ওশান ভাইকিংয়ের ২৫ থেকে ৩০ জুনের অভিযান কালক্রম
২২শে জুন ওশান ভাইকিং মধ্য ভূমধ্যসাগরে যাত্রা শুরু করে ও ২৫শে জুন ইতালীয় ও মাল্টিজ এসএআর অঞ্চলে কাঠের নৌকা থেকে ৫১ জনকে উদ্ধার করে। দ্বিতীয় দফায় ৬৭ জনকে এবং ৩০শে জুন সর্বশেষ অভিযানে এসওএস অনুসন্ধানকারী দলটি ল্যাম্পেদুসার দক্ষিণে প্রবাহিত একটি কাঠের নৌকা থেকে ৪৭ জনকে উদ্ধার করে। তথ্যসূত্রে জানা যায়, মোট ১৮০ জনের মধ্যে (একজনকে চিকিৎসার প্রয়োজনে সরিয়ে নেয়ার পর) ২৭ বছর বয়সী রবিউল নামের একজন বাংলাদেশী সেখানে উপস্থিত ছিল।
অন্যদিকে, ইত্তেফাক ২৫শে জুলাই ছাপিয়েছে, ঘটনাটি মাত্র এক সপ্তাহ আগের, যা তথ্যমতে অসম্ভব। কারণ যাত্রীদের নামিয়ে দেয়ার পর, সামুদ্রিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, জাহাজটি পোর্তো এম্পেডোকল বন্দরে আগামী ২২শে জুলাই পর্যন্ত নোঙ্গর করা ছিল।
দীর্ঘ ১১ ঘণ্টা তদারকি করার পর ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষ ওশান ভাইকিং আটক করে রাখে, অতিরিক্ত যাত্রী বহনের নিয়ম লঙ্ঘন করায়। এমনকি, এসওএস মেডিটেরিন -এর ওয়েবসাইটে বা তাদের অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে জুলাই মাসে কোন উদ্ধার অভিযানের কথা নেই, বাংলাদেশী কাউকে উদ্ধার করার সেখানে প্রশ্নই আসছে না।
ফ্যাক্টওয়াচ এর পক্ষ থেকে ইত্তেফাকের একজন সাংবাদিকের কাছে তাদের ইতালি-সংবাদদাতার কথা জানতে চাইলে, তিনিও পরিস্কার বলতে পারেননি, আদৌ ইতালিতে কোন সংবাদদাতা তাদের আছে কিনা এ মুহূর্তে! এখানে, প্রতিবেদনের মূল দাবিটাই প্রশ্নবিদ্ধ এবং অপ্রমাণিত থেকে যায়।
উপরন্তু, যে ছবিটি প্রকাশ করা হয়েছে সেটি মূলত গ্রান কেনেরিয়ার একটি বন্দরের ছবি। ‘সালভামেন্টো মারাতিমো’ স্পেনের সামুদ্রিক সুরক্ষা ও উদ্ধার সমিতি যখন একটি নৌকায় ১২ জন শিশুসহ মোট ৩৪ জন অভিবাসী উদ্ধার করে, ছবিটি সে সময়ে তোলা হয়।
সংবাদটির প্রতিবেদক আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ২০১৯ -এর পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেছেন “গতবছর প্রায় ১ লক্ষাধিক অভিবাসী ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া ও তিউনিশিয়া হয়ে ইতালিতে প্রবেশ করে। এছাড়াও একই বছরে প্রায় ১২’শ অভিবাসীর মৃত্যু হয় এই ভূ-মধ্যসাগরে।” ইত্তেফাকের রিপোর্টে এ বার্তাটিও ভুল ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
বিবিসি সূত্রে জানা যায়, গতবছর ১১০,০০০ এরও বেশি অভিবাসী গতবছর ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং এই প্রচেষ্টার সময় ১২০০এর এরও বেশি মানুষ মারা পড়ে। তবে এই এক লক্ষাধিক অভিবাসী কেবল ইতালিতে প্রবেশ করে না, বরং ইউরোপের অন্যান্য দেশে যেমন গ্রীস, মালটা, সাইপ্রাস ও স্পেনেও যায়।
এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সম্পূর্ণ রিপোর্টটি পড়ুন
ফ্যাক্ট-চেক কার্যপ্রণালি
ফ্যাক্টওয়াচ সর্বপ্রথম এই প্রতিবেদনটির শিরোনাম ও ছবিটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। গুগল রিভার্স-ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ছবির অপ্রাসঙ্গিকতা উদ্ঘাটিত করার পর সে সূত্র ধরেই প্রতিবেদনটির বাকি দাবিগুলোর উপর সূক্ষ্ম নিরীক্ষা চালানো হয়।
অতপর, এসওএস মেডিটেরানি-এর ওয়েবসাইট, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার পরিসংখ্যান প্রতিবেদন, ২০১৯ এবং নির্ভরযোগ্য কিছু গণমাধ্যমের সমবায়ে তথ্যের অপ্রামাণিক দাবিগুলোর সাথে সাথে একাধিক ভুল তথ্যও বের করে আনা হয়।