গত মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) রাতে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ নামে একটি গান ফেসবুকে এবং ইউটিউবে প্রকাশিত হয়, যা মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়। তবে প্রকাশের পরেই তুমুল আলোচনা ও সমালোচনার মুখে পড়ে গানটি, অভিযোগ ওঠে পাইরেসির। কপিরাইট সনদ সহ গানটির স্বত্ত্বাধিকার দাবী করে ‘সরলপুর’ ব্যান্ড। গানটিকে লোকগীতি হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না, সে বিষয়ে সঙ্গীতজ্ঞ এবং আইনবিদদের বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। লোকগীতিকে আধুনিক আইনের আওতায় এনে এর ওপর কারো স্বত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না, তা-ও বৃহত্তর বিতর্কের বিষয়বস্তু। কিন্তু দেশের বিদ্কযমান আইন অনুযায়ী গানটির আইনি স্বত্ত্বাধিকার সরলপুর ব্যান্ডের।
গত ২০শে অক্টোবর ফেসবুকে Poetree-কবৃক্ষ নামের একটি পেইজ থেকে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামে একটি গানের ভিডিও প্রকাশিত হয়, যেটিকে তারা “একটি জনপ্রিয় লোকজ গান” বলে উপস্থাপন করেন। গানটি গেয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন পার্থ বড়ুয়া। ভিডিওটির ক্যাপশনে গানের কথার জায়গায় লেখা ছিলো ‘সংগৃহীত’।
এর পর পরেই ফেসবুকে তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠে। মূল গানটি ‘সরলপুর’ নামের একটি ব্যান্ডের বলে সবাই দাবী করতে থাকেন। আবার এর বিপক্ষে অনেকে বলতে থাকেন গানটি আরও আগে থেকে লোকগীতি হিসেবে পরিচিত।
শেরপুর ট্রিবিউন নামের একটি অনলাইন পোর্টাল থেকে “শেরপুরের ব্যান্ড “সরলপুর” এর গান পাইরেসির শিকার।“ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হয় “বিষয়টি নজরে আসে শেরপুরট্রিবিউন প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম জনি’র। তিনি সরলপুর ব্যান্ডের তারিকুল ইসলাম তপনের সাথে “সর্বত মঙ্গল রাধে” গান সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, গানটি তারিকুল ইসলাম তপন ও আতিকুর রহমান যৌথভাবে রচনা করেন, গানটির কম্পোজিশন করেন সরলপুর ব্যান্ড লীলা কীর্তন অনুসারে। গানটি কপিরাইট স্বত্বও তারিকুল ইসলাম তপনের নামে। গানটি সরলপুর ব্যান্ডের হয়ে দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন শো’তে পারফর্ম করেন মারজিয়া আমিন তুরিন ও তরিকুল ইসলাম তপন।”
ছবি: শেরপুর ট্রিবিউন
ভিডিওতে সরলপুর ব্যান্ডের দাবি, ২০০৮ সালে বকশিগঞ্জের এক বৃদ্ধ সাধুর কাছ থেকে তারা গানটি শোনেন। তবে পুরো গানটি পাওয়া যায়নি, ৩০ ভাগ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর ব্যান্ড দলের সদস্য আল আমিন এবং তপন বাকি ৭০ ভাগ গান রচনা করেন। পরে গানটির কম্পোজিশন করা হয়। ২০১২ সালে ‘যুবতী রাধে’ নামে গানটি রেকর্ড করে ঐ সময় চ্যানেল নাইনে গানটি পরিবেশন করে ব্যান্ড দলটি।
গতকাল সরলপুর ব্যান্ডের ফেসবুক পেইজ থেকে একটি লাইভ ভিডিওতে ব্যান্ডের দুই সদস্য গানটি তাদের বলে দাবী করেন এবং তাদের কাছে গানটির কপিরাইট সনদ আছে বলেও জানান। ইন্টার্নেট থেকে যতদ্রুত সম্ভব IPDC কে তাদের ভিডিওটি সরিয়ে নেবার অনুরোধ করেন। এরপর গতকাল মার্জিয়া তুরিন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গণমাধ্যমকর্মীবৃন্দদের উদ্দেশ্যে একটি পোস্ট লিখেন এবং তাদের কপিরাইট সনদের ছবি প্রকাশ করেন।
সরলপুর ব্যান্ডের দুই সদস্য মার্জিয়া তুরিন ও তারিকুল ইসলাম তপনের মৌখিক বিবৃতি
গানটিকে কপিরাইট আইনের বাইরে ভাবার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে সংলাপ্ধর্মী গানটির বিষয়বস্তু, এর সুর এবং উপস্থাপনার লৌকিক বৈশিষ্ট্য। শিল্পী মেহের আফরোজ শাওন ফ্যাক্ট-ওয়াচকে ফেইসবুক মেসেন্জারে এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানান:
“এই গানটা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন। যতদূর জানা গেছে দ্বিজ কানাই নামক একজন বাউল সাধকের লেখা কীর্তন হবার সম্ভাবনা আছে। প্রায় ৭০ বছর আগের গান। মুখে মুখে গাওয়া হতো, লিখিত আকারে ছিল না। তাই যারা গাইতেন দু’একটি শব্দ এদিক ওদিক করে গাইতেন। এধরনের গানের কোনো একক কপিরাইট হয় না। মুখে মুখে প্রচলিত গানের সাথে নিজস্ব এক দুই লাইন এমনকি এক প্যারা জুড়ে দিলেও এটা কারো ব্যক্তিগত গান হতে পারে না।”
গানটির একক কপিরাইট হয় কি না, সেটা আইন এবং সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। এই বিষয়টি আমাদের ফ্যাক্ট-চেকের আওতার বাইরে। তবে এই বিষয়ে সামনে যেকোন তথ্য পাওয়া গেলে আমরা তা প্রকাশ করব।
এবিষয়ে গানের অন্যতম মূল শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী তার শেয়ারকৃত পোস্টের কমেন্টে লিখেছেন, “খুবই অবাক হলাম….কেউ একজন কপিরাইট ক্লেইম করেছে… বলার কোন ভাষা নেই…।”
গত রাতে সরলপুর ব্যান্ড গণমাধ্যমের কাছে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে:
“গানটি নিয়ে প্রথম বিভ্রান্তি তৈরি করেন সুমি মির্জা নামের এক কথিত শিল্পী। তিনি গানটির কথা পরিবর্তন করে লেজার ভিশনের ব্যানারে তাঁদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করেন। ইউটিউবের কমেন্টে আমাদের সে গানটিকে তিনি পালা গান, মহুয়া গান, গোয়ালিনী গানসহ নানা নামে প্রচার করেন। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হই।
পরে কপিরাইট অফিস থেকে আমাদের দুই পক্ষকে ডাকা হয়, সুমী মির্জা গানটিকে মৈমনসিংহগীতিকার মহুয়া গান কিংবা গোয়ালিনী গান বলে দাবি করলেও কোনো প্রমাণ দেখাতে না পারায় দুটি শুনানির মাধ্যমে গানটির সত্যতা প্রকাশ হয় এবং গানটির কপিরাইট আমরা পাই। পরবর্তী সময়ে তিনি আমাদের ‘যুবতী রাধে’ গানটির সুর ও কথার অংশ হুবহু নকল করেন, ‘বিনোদিনী রাই’ নামে আরেকটি গান প্রকাশ করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গানটির কপিরাইট নিয়ে নেন।“
সুমি মির্জার গানটির বিভিন্ন ভিডিও ইউটিউবে দেখা যায়। এছাড়া বিভিন্ন শিল্পীরা গানটির কাভার পরিবেশন করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যেখানে সুমি মির্জাকেই গানটির রচয়িতা দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশে সঙ্গীতের আইনি অধিকার ২০০০ সালের কপিরাইট এক্ট এবং ২০০৬ সালের কপিরাইট নীতিমালার আওতায় পড়ে। এই আইন অনুযায়ী কপিরাইট মালিকের অনুমতি ছাড়া যদি কোন গান পরিবেশন করা হয়, তাহলে শিল্পী এবং আয়োজক উভয়কেই আইনের আওতায় আনা সম্ভব। শাওন ও চঞ্চল চৌধুরী গানটিকে যেভাবে পরিবেশন করেছেন, তার সাথে সরলপুরের কপিরাইট করা গানের কথার কোন পার্থক্য নেই। অতএব এটিকে একটি কাভার সং হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি জুনায়েদ চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, কপিরাইট এক্ট ২০০০-এ একই গানের নতুন পরিবেশনা বা “কাভার সং” এর কোন সংজ্ঞা দেওয়া হয় নি। আইনের ভাষায় কাভার সং কে “ভার্সন রেকর্ডিং” বলা যায়। সেকশন ৭২(১০) অনুসারে কপিরাইট আইন ভঙ্গ না করে এই ভার্সন রেকর্ডিং করা সম্ভব যদি কিছু শর্ত মেনে চলা হয়। শর্তের দীর্ঘ তালিকার মধ্যে রয়েছে কপিরাইট মালিকের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ এবং তাকে যথোপযুক্ত রয়ালটি প্রদান। স্পষ্টতই এক্ষেত্রে গানের শিল্পী, প্রযোজক/পরিচালক বা অনুষ্ঠানের সংগঠকরা তা করেন নি।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
লোকগীতি-কে আধুনিক আইনের আওতায় এনে এর ওপর কারো স্বত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় কি যায় না, সেটা একটি বৃহত্তর বিতর্কের বিষয়বস্তু।কালচারাল স্টাডিজ বিশেষজ্ঞ ড. সুমন রহমান এ বিষয়ে ফেসবুকে তার লিখেছেন,
“ফোকলোর ক্যাটাগরিটাই সমস্যাজনক, আধুনিক জমানায়। ব্যক্তির অধিকার এবং আইডেন্টিটি আইনীভাবে স্বীকৃত থাকবার পর গানের কথা কিংবা সুর হয় “সংগৃহিত” কিংবা “অজ্ঞাত”! শোনা যায়, ফেসবুকেরও নাকি সবচেয়ে পঠিত লেখকের নাম “সংগৃহিত”। এই সংগ্রহলীলা ব্যক্তির বুদ্ধিস্বত্ত্বের অধিকারকে খর্ব করে।”
বকশীগঞ্জের সেই সাধুর কাছে তাদের ঋণ অনস্বীকার্য হলেও সরলপুর ব্যান্ডের উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আমাদের সিদ্ধান্ত: আইনের দৃষ্টিতে সরলপুর ব্যান্ড-ই গানটির স্বত্ত্বাধিকারি।