২৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ‘রামায়ণ-মহাভারতকে সৌদি আরবের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে’ শীর্ষক একটি খবর বাংলাদেশ এবং ভারতের কিছু শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘Nouf Almarwaai’ নামের একজন সৌদি নাগরিকের একটি টুইটকে কেন্দ্র করেই মূলত সংবাদগুলো প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে, সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ প্রকল্পের আওতায় দেশটির স্কুল পাঠ্যসূচিতে যোগ করা হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারত। কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচ তার অনুসন্ধানে এই দাবির পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ খুঁজে পায় নি। বরং জানা গেছে সেখানে অবস্থিত কিছু ভারতীয় স্কুলে রামায়ণ-মহাভারত পড়ানো হয় ভারতীয় ছাত্রদের জন্য। এই পাঠ্যক্রম সৌদি আরবের শিক্ষা পাঠ্যক্রমের মূলধারায় এসেছে – এমন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় নি। ফলে, সংবাদটি মিথ্যা।
গত ১৫ই এপ্রিল নউফ আলমারওয়াই নামে একজন সৌদি-নিবাসী ভারতীয় নারী টুইটে তার ছেলের স্কুলের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষায় হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, রামায়ণ ও মহাভারত সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের স্ক্রিনশট শেয়ার করেন। সেখানে তিনি লিখেন, সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ এবং এর নতুন পাঠ্যক্রম একটি সহাবস্থানে বিশ্বাসী ও সহনশীল প্রজন্ম গড়ে তুলবে।
নউফ আলমারওয়াই’র এই টুইটের ভিত্তিতেই মূলত ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকাগুলো ‘সৌদি আরবের স্কুল পাঠ্যসূচিতে যোগ করা হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারত’ শীর্ষক সংবাদটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনগুলোতে কেবল এই টুইটকেই সোর্স হিসিবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। “শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন সংক্রান্ত সকল বিভ্রান্তি উড়িয়ে দিয়েছে নউফ আলমারওয়াই নামের টুইটার একাউন্টের টুইটটি” এমনটাই দাবি করছে Indiatoday।
‘আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন’ তাদের শিরোনামে লিখেছে, “সৌদির পাঠ্যক্রমে ঢুকল রামায়ণ, মহাভারত, যুবরাজ সলমনের নয়া উদ্যোগ”
‘Hisdustantimes বাংলা’ লিখেছে “রামায়ণ-মহাভারতকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করল সৌদি আরব”
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ২৪শে এপ্রিল সংখার শিরোনামে লিখেছে “সৌদির স্কুলে পড়ানো হবে রামায়ণ-মহাভারত”
তবে সৌদি আরবের স্কুল পাঠ্যক্রমে রামায়ণ ও মহাভারত স্থান পেয়েছে এমন কোন সংবাদ সে দেশের কিংবা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়নি। তবে সৌদির কোন গনমাধ্যমে এ নিয়ে লেখালেখি হলেও ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে তা যাচাই করা যায়নি।
সৌদি সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এ ধরণের কোন বিবৃতি দেয়া হয়নি। মারওয়াই এর টুইট এবং সেটিকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমগুলো সৌদি ভিশন ২০৩০ প্রকল্প এবং এর নতুন পাঠ্যক্রম বিষয়টি উল্লেখ করলেও তারা কোন প্রকার তথ্য-প্রমাণ সংযুক্ত করেনি প্রতিবেদনগুলোতে। ফ্যাক্টওয়াচ টিম ‘সৌদি ভিশন ২০৩০’ এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও নতুন স্কুল পাঠ্যক্রম-সংক্রান্ত কোন তথ্য খুঁজে পায়নি।
Indiatoday আরও বলেছে, “নতুন পাঠ্যক্রমের অধীনে সৌদি আরবের শিক্ষার্থীরাও এখন রামায়ণ ও মহাভারতের মতো হিন্দু মহাকাব্যের পরিচয় ও ইতিহাস জানবে”। তবে সেক্ষেত্রে সৌদির নির্দিষ্ট কোন স্কুলের শিক্ষার্থী নাকি দেশটির সকল স্কুলের শিক্ষার্থী, এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা হয়নি প্রতিবেদনে। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন সংক্রান্ত সকল বিভ্রান্তি উড়িয়ে দিয়েছে নউফ আলমারওয়াই নামের টুইটার একাউন্টের টুইটটি।
অথচ সৌদি যুবরাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সৌদি ভিশন ২০৩০ ওয়েবসাইটে শিক্ষাব্যবস্থাসহ নানা খাতে পরিবর্তন নিয়ে আসার কথা উল্লেখ থাকলেও সেখানে কোথাও নির্দিষ্ট করে স্কুলের পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের তথ্য নেই, নেই রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্তির কথা।
কীভাবে বিভ্রান্তিটি ছড়ালো?
নউফ আলমারওয়াই এর টুইটটি ইংরেজি ভাষায় করা হলেও টুইটার ব্যবহারকারীরা প্রায় সকলেই আরবি ভাষায় তাদের মন্তব্য রেখেছেন। প্রথমে কিছু মন্তব্য ঘেঁটে জানা যায়, যে স্কুলটির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তা একটি ভারতীয় আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমের আওতাভুক্ত। Khaled Homoud Alshareef নামের একজন টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন, “এটি নতুন কিছু নয়, ভিন্ন ভাষাভাষী স্কুলগুলি কয়েক দশক ধরেই নিজ নিজ দেশের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পড়ায় “(আরবি থেকে বাংলায় তর্জমা)।
আরেকজন লিখছেন, “আমরা সকল ধর্মকে সম্মান করি, এবং সংস্কৃতির মধ্যে জ্ঞান বিনিময়কেও স্বাগত জানাই। আমাদের স্কুলগুলোতে ছাত্রদের কেবল তাদের নিজ ধর্মের শিক্ষা দেয়া হয়। অন্যদিকে, ভিন্ন ভাষাভাষী স্কুলগুলি তাদের দূতাবাসগুলোর সাথে সম্পর্কিত বিধায় নিজ নিজ বিশ্বাসের শিক্ষা দিতে পারে। কিন্তু সেটা আমাদের স্কুলে নয়।”
আরেকজন প্রশ্ন রেখেছেন, “তবে কেন মারওয়াইকে ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভুল তথ্য ছড়ানোর সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ভারতীয় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে তা প্রকাশিত হবার পরেও কেন দিল্লির সৌদি দূতাবাস এটির বিরোধিতা করছে না?”
টুইটগুলো পড়ুন এখানে
এই বাদানুবাদকে কেন্দ্র করে মারওয়াই ২৫শে এপ্রিল আরেকটি টুইট করেন। যদিও সেখানে তিনি স্বীকার করে নেন যে উল্লেখ্য স্কুলটি একটি আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে যা সৌদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা অনুমোদিত। কিন্তু সেটা যে সৌদির জাতীয় বা মূল পাঠ্যক্রমের থেকে ভিন্ন তা এড়িয়ে গিয়ে পুনরায় তর্কের তোপে পড়েন।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
সৌদি আরবের স্কুল পাঠ্যক্রমে রামায়ণ ও মহাভারত অন্তর্ভুক্তি বিষয়ক কোন সরকারি বা নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। ভিন্ন ভাষাভাষী স্কুলে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুযায়ী পাঠ্যক্রম চালু আছে পৃথিবীর অনেক দেশে। সে অনুযায়ী, সৌদি আরবে অবস্থিত কোনো ইন্ডিয়ান স্কুলে রামায়ণ-মহাভারত পাঠ্যক্রমে থাকতেই পারে। কিন্তু তার ভিত্তিতে সৌদি মূলধারার পাঠ্যক্রমে রামায়ণ-মহাভারত পড়ানো হয় – এই দাবি অসত্য।