সামাজিক মাধ্যমে খুব পরিচিত একটি ছবি বেশ কয়েক বছর ধরে শেয়ার হচ্ছে এবং দাবি করা হচ্ছে ছবিটি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া কলকাতার শেষ ট্রেন। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে যে, ছবিটি ১৯৪৭ সালের নয় বরং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের ভারতের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার সময়ে তোলা। রেমন্ড দেপার্ডন নামক একজন ফরাসি ফটোগ্রাফারের তোলা ‘Exodus’ বা প্রস্থান শিরোনামের ছবি এটি। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ উক্ত ছবিটির সাথে করা দাবিকে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করছে।
শেয়ারকৃত পোস্টগুলোতে ব্যবহৃত ছবির সঙ্গে ১৯৪৭ সালে ঢাকা থেকে কলকাতাগামী শেষ ট্রেনে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন সম্পর্ক আছে কিনা সেটা যাচাই করতে আমরা উক্ত ছবিটি ব্যবহার করে বিভিন্ন রিভার্স ইমেজ সার্চ টুলস ব্যবহার করে জানতে পেরেছি যে, ছবিটির সাথে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কোন সম্পৃক্ততা নেই এবং ছবিটি ১৯৭১ সালে রেমন্ড দেপার্ডন (Raymond Depardon) নামক একজন ফরাসি ফটোগ্রাফারের তোলা যখন পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন দুর্ভিক্ষ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে। রেমন্ড দেপার্ডন এর তোলা এই ছবিটির শিরোনাম হচ্ছে ‘Exodus’ বা প্রস্থান, যার অর্থ হচ্ছে দলবদ্ধভাবে কোন গোষ্ঠী বা জাতি যখন তাদের স্বদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। টাইম ম্যাগাজিনের ‘Bangladesh and Pakistan: The Forgotten War’ শিরোনামের ফটো-স্টোরিতে রেমন্ড দেপার্ডন এর তোলা ছবিটি দেখুন এখানে।
উক্ত ছবিটিকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়কার মনে করে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি সম্পর্কিত সংবাদগুলোতে ব্যবহার করেছে বেশকিছু গণমাধ্যম। এমন কিছু সংবাদ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে।
রেমন্ড দেপার্ডন এর তোলা ছবিটি ১৯৭১ সালে সংঘটিত পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কিত সংবাদগুলোতে ব্যবহার করেছে বেশকিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এমন কিছু সংবাদ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে উভয় পক্ষের সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে কারা সঠিকভাবে ছবিটি ব্যবহার করেছে? উপরোক্ত সংবাদগুলো যাচাই করে একটি বিষয় লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, যারা উক্ত ছবিটিকে ১৯৪৭ এ দেশবিভাগের সময়কার মনে করে ব্যবহার করেছে তারা কেউই ছবিটির উৎস বা ফটোগ্রাফারের নাম উল্লেখ করে নি বা করতে পারেনি। অপরদিকে, যে সকল সংবাদমাধ্যমগুলো ঐ একই ছবিটি ১৯৭১ এ পূ্র্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ সম্পর্কিত সংবাদগুলোতে ব্যবহার করেছে তারা ছবিটির কৃতিত্ব দিয়েছে ফরাসি ফটোগ্রাফার রেমন্ড দেপার্ডন কে। যারা এই ছবির উৎস হিসেবে রেমন্ড দেপার্ডন এর ক্রেডিট ব্যবহার করেছে তারাই বিভ্রান্তি এড়াতে পেরেছে। তাছাড়া, আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষ্যণীয় যে রেমন্ড দেপার্ডন এর জন্ম ১৯৪২ সালের ৬ই জুলাই। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, তিনি ১২ বছর বয়সেই প্রথম ছবি তোলা শুরু করেন। সুতারাং, তার পক্ষে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়কার ছবি তোলা প্রায় অসম্ভব।
রেমন্ড দেপার্ডন এর তোলা এই ছবিটি শিল্পসাহিত্য চলচ্চিত্রেও ভুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৫৬ সালে ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ নামক একটি উপন্যাস লিখেন যার পটভূমি ছিলো ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি এবং এই বইটির স্প্যানিশ অনুবাদের একটি সংস্করণের প্রচ্ছদে রেমন্ড দেপার্ডন এর তোলা ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। দেখুন এখানে।
তাছাড়া, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল ২০১৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগ নিয়ে ‘সীমান্তরেখা’ নামক একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। উক্ত তথ্যচিত্রটির পাঁচমিনিট ৫৬ সেকেন্ডে রেমন্ড দেপার্ডন এর তোলা স্থিরচিত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বিদেশী ফটোগ্রাফার বাংলাদেশে এসেছিলেন যুদ্ধের ছবি ধারণ করতে এবং রেমন্ড দেপার্ডন তাদের মধ্যে একজন।
অতএব, এ বিষয়টি স্পষ্ট যে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোতে ব্যবহৃত ছবিটি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ঢাকা থেকে কলকাতাগামী শেষ ট্রেন নয় বরং এটি ১৯৭১ সালে রেমন্ড দেপার্ডন এর তোলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালের একটি ছবি।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোর দাবি “মিথ্যা।”
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?