গণমাধ্যমের পুরনো প্রতিবেদনগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে,সেদিন ‘দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ব্যানারে আন্দোলনকারীদের মিছিলে ছাত্রলীগ হামলা করেছিলে,যাতে আসিফ মাহমুদ আহত হয়েছিলেন। ইভটিজিং এর কোনো খবর সেদিনের সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায় নি। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এ সকল দাবিকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
যা ছড়িয়েছে
২৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও , এবং এর বিভিন্ন অংশের স্ক্রিনশট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিওতে থাকা হলুদ টি-শার্ট পরিহিত আহত একটি যুবকের আহত হওয়ার নেপথ্য কারণ নিয়ে গুজব তৈরি হয়েছে।
যে ধারণা দেয়া হচ্ছে
২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টোম্বর ঢাবি'তে তানজিন আসিমা নামের একটি মেয়েকে উত্যক্ত করবার জন্য ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে গনপিটুনির শিকার হয়েছিল আসিফ মাহমুদ, যে বর্তমান সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। ভাইরাল ভিডিওতে থাকা এই তরুণই হলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিটি আসিফ মাহমুদ, এটা সত্য। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও ছবির আলোকে জানা যাচ্ছে যে ২০১৯ এর ১৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে ‘দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এর ব্যানারে থাকা আন্দোলনকারীদের উপরে আক্রমণ চালিয়েছিল ‘সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে থাকা একদল ছাত্রলীগ কর্মী। আসিফ মাহমুদ সে সময় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। কোনো নারীকে উত্যক্ত করার কোনো খবর বা দাবি সে সময়ে কোনো গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়নি। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
২৪ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে প্রথম ১৩ সেকেন্ডে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু আন্দোলনকারী জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছে। আন্দোলনকারীদের কেন্দ্রস্থলে হলুদ টি-শার্ট পরিহিত এক যুবকের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়,যার বাম চোখের নিচের আহত জায়গা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে । মূল ভিডিওর অডিও রিমুভ করে সেখানে ভিন্ন গান ( ওয়েভিং ফ্লাগ-কেনান) যুক্ত করার কারণে স্লোগানগুলো শোনা যাচ্ছেনা। ভিডিওর শেষ অংশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই তরুণ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ এর শপথ গ্রহণ এবং বক্তৃতাসহ কয়েকটি ক্লিপ দেখানো হয়।
এসব পোস্টের ক্যাপশনে বলা হয়েছে, – ছেলেটা কে? ভালো করে দেখেন চিনে যাবেন।
২০১৯ সালে আজকের দিনে মানে ১৯ সেপ্টোম্বর ঢাবি’তে তানজিন আসিমা নামের একটি মেয়েকে উত্যক্ত করবার জন্য ক্যাম্পাসে সাধারণ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে গনপিটুনি খায় সে।
আজ সেই গন পিটুনির ৫ বছর পূর্ণ হলো। এই ছেলেকে চিনেন আপনারা। বলেন তো কে এই ছেলে?
অর্থাৎ, এই ভিডিওর ক্যাপশনে সরাসরি কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে ভিডিওতে দেখানো সূত্র থেকে অনেকেই এসব পোস্টে কমেন্ট করে জানাচ্ছেন যে এই ভিডিওর উক্ত তরুণই উপদেষ্টা আসিফ।
২০১৯ এর উক্ত ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস এবং জাস্ট নিউজ বিডি নামক দু’টি অনলাইন পোর্টাল।
১৮ই সেপ্টেম্বর,২০১৯ তারিখে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসে প্রকাশিত ঢাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ছাত্রলীগের হামলা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিলসহ তিন দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আজ বুধবার বেলা ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
তিন দফা দাবির মধ্যে রয়েছে, যারা অবৈধভাবে ভর্তি হয়েছেন তাদের ছাত্রত্ব ও ডাকসুর পদ বাতিল করে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে খালি পদগুলোতে দ্রুত উপনির্বাচন দেওয়া। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের পদত্যাগ করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী তিন দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কয়েকটি বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে তারা ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে স্মারকলিপি দিতে যান। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে চার দফা দাবিতে স্মারকলিপি দিতে গেলে সেখানে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের মারধর শুরু করলে তারা সেখান থেকে চলে আসেন।
এতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বাম সংগঠনের কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এরমধ্যে আসিফ মাহমুদ নামে একজন গুরুতর আহত বলে তারা জানিয়েছেন।
এই খবরের সাথে আহত যুবকের যে ছবি ছাপানো হয়েছে, তাঁর সাথে ভাইরাল ভিডিওর যুবকের পোষাক পরিচ্ছদ এবং বাম চোখের নিচের ক্ষতচিহ্নের হুবহু মিল দেখা যাচ্ছে।
জাস্ট নিউজ বিডি তে ১৮ই সেপ্টেম্বর,২০১৯ তারিখে প্রকাশিত ঢাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ব্যানারে আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের কার্যালয় ঘেরাও করেন ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ও স্বতন্ত্র জোটের নেতা-কর্মীরা ।——–
একই সময়ে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ এলাকায় যান ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের (ডাকসুর এজিএস) অনুসারী একদল নেতা-কর্মী। নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি হওয়া ৩৪ জনের মধ্যে সনজিতের নামও রয়েছে।
সনজিত ও সাদ্দামের অনুসারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের নেতৃত্বে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। হামলায় আসিফ মাহমুদ (ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী) নামে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের একজন কর্মীর চোখে গুরুতর আঘাত লেগেছে। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আন্দোলনকারীরা জানান, আসিফের বাম চোখের নিচে ১৫টি সেলাই পড়েছে।
এই প্রতিবেদনে আহত আসিফ মাহমুদের ভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে ধারন করা আরেকটি আলোকচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানেও টি-শার্ট এবং ক্ষতিচিহ্নের মিল রয়েছে। ।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ এর ‘এবাউট’অংশ থেকে জানা যাচ্ছে,তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Linguistics (ভাষাবিজ্ঞান) বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন, এবং তিনি ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এই বিভাগে ছিলেন। সেই বিচারে, ২০১৯ সালে তাঁর দ্বিতীয় বর্ষে থাকার কথা, যে তথ্যগুলো জাস্টনিউজ বিডি এর প্রতিবেদনের সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ, ২০১৯ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর আহত যুবক আসিফই আজকের দিনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত আসিফ মাহমুদ-এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
Asif Mahmud Shojib Bhuyain নামক ভেরিফাইদ পেজ থেকে ১৯শে সেপ্টেম্বের রাত ১ টা ১৩ মিনিটে (অর্থাৎ ১৮ই সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে) ২৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়, যার ক্যাপশনে বলা হয়, ২০১৯ সালের এই দিনে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন আসিফ মাহমুদ। ভর্তি জালিয়াতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রায় চোখ হারাতে বসেছিলেন সন্ত্রাসীদের হামলায়। থানায় গেলেও নেওয়া হয়নি জিডি।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ও দৃঢ় মানসিকতাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত করেছে আসিফ মাহমুদদের।
এই ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ব্যানারের সামনে আহত আসিফ মাহমুদকে কেন্দ্রস্থলে রেখে কতিপয় বিক্ষুব্ধ কর্মী স্লোগান দিচ্ছে। তাদের স্লোগানের মধ্যে ছিল – শিক্ষা সন্ত্রাস /একসাথে চলে না, শিক্ষা ছাত্রলীগ/একসাথে চলে না, আমার ভাই আহত কেন/প্রশাসন জবাব চাই,সন্ত্রাসীদের কালো হাত/ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও ইত্যাদি। এখানে সামনের ব্যানারের শিরোনামটি সুস্পষ্টভাবে পড়া না গেলেও, ‘দাবি সমূহ’ এবং ‘বিজনেস’ স্টাডিজ কথাদুটি পড়া যাচ্ছে।
‘দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক ফেসবুক পেজে ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে আপলোড করা পোস্টারে দেখা যাচ্ছে, ‘আমাদের দাবি সমূহ’ শিরোনামে মোট ৩ দফা দাবি ছিল। যার প্রথম দফা ছিল- ভর্তি জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত উপাচার্য ড আখতারুজ্জামান ও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত ইসলামকে পদত্যাগ করতে হবে।
একই লেখাযুক্ত ব্যনারের ছবি প্রকাশিত হয়েছিল জাস্ট নিউজ বিডি এর প্রতিবেদনে। অর্থাৎ এটা নিশ্চিত যে ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে আসিফ মাহমুদ ‘দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এর এই কর্মসূচীতেই উপস্থিত ছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন।
২০১৯ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বরের এই হামলার ঘটনাটি ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেলে ভিডিও প্রতিবেদন আকারেও প্রকাশিত হয়েছিল। এসব চ্যানেলের মধ্যে রয়েছে প্রথম আলো, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন,নিউজ২৪, বার্তা ২৪, ইসলামিক অনলাইন টিভি ইত্যাদি। এসব প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে আসিফ মাহমুদের উপরে হামলার তথ্য না থাকলেও সাধারণভাবে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা শিক্ষা অনুষদ ঘেরাওকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা’ এর তথ্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, কোনো নারী শিক্ষার্থীকে উত্যক্ত করার কোনো তথ্যও এসব প্রতিবেদনে নেই।
এছাড়া, এসব প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে আসিফ মাহমুদের আহত হওয়ার এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে, ১৯তারিখে নয়,যেমনটা ভাইরাল ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হচ্ছে।
No Factcheck schema data available.
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের
নীতি মেনে লেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে।
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।
কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh