কানাডায় আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছে দেশের ৩৩ বিশ্ববিদ্যালয়- শীর্ষক একটি খবর ভাইরাল হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, প্রকাশিত খবরটি বিভ্রান্তিকর। এখানে কানাডার একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় (ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইন্সটিটিউশন অফ টেকনোলজি)-এ বাংলাদেশের ৩৩ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সনদ মূল্যায়নের অক্ষমতার কথা জানা যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের কোনো ঘাটতির কারণে হয়নি, বরং যোগ্যতা মূল্যায়ণকারী কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান ICES এর সক্ষমতার অভাবে ঘটছে। এছাড়া, উক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে কানাডার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের আলোচ্য ৩৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেতে কোনো বাধা নেই।
সময় নিউজ এ প্রকাশিত এই খবরে বলা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার জন্য তরুণদের অন্যতম পছন্দের দেশ কানাডা। কিন্তু সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটধারীরা কানাডার জন্য মূল্যায়নের যোগ্যতা হারিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডেনশিয়াল ইভালুয়েশন সার্ভিস (আইসিইএস)- এর ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। —————– আইসিইএস দ্বারা বাংলাদেশের ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যায়ণ করা যায়নি বলে জানানো হয়েছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটধারীরা কানাডার জন্য মূল্যায়ণের যোগ্যতা হারিয়েছেন, তার তালিকা ———— ।
ফেসবুকে বিতর্ক
এই খবরটা ফেসবুকে প্রকাশ হওয়ার পরেই সচেতন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই খবরটা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন । অনেকে খোঁজ খবর করে এই সংবাদের অসারতা সম্পর্কে কমেন্ট করেন। এমন কিছু কমেন্ট দেখুন –
এসব কমেন্টে তারা জানান, খবরটা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়, British Columbia Institute of Technology (BCIT) এর বিদেশী শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট মূল্যায়নের সার্ভিস হল International Credential Evaluation Service বা ICES . এই BCTI এ পড়াশোনার জন্য ICES এর মাধ্যমে বিদেশী শিক্ষার্থীদের সনদ মূল্যায়িত করার প্রয়োজন হয় ( সকল কোর্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়)। তবে IECS সকল দেশ এবং সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ মূল্যায়ণ করতে পারেনা। যেমন- এরা বাংলাদেশের উল্লেখিত ৩৩ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সনদ মূল্যায়ণ করতে পারে না। এবং এই ৩৩ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা সাম্প্রতিক নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরেই তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। বাংলাদেশের উক্ত ৩৩ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ যদি কানাডায় পড়তে যেতে চান, তাহলে BCTI বাদে কানাডার অন্যন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দ্বিধায় পড়তে যেতে পারেন। BCTI এ পড়তে চাইলেও , নির্দিষ্ট কোর্স এর জন্য IECS এর মূল্যায়ণ না নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার পিএইচডি গবেষক নাজমুল হাসান তপুর একটি মতামত অনেকে কপি করে কমেন্ট করেন। তিনি জানান- সবাইকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই পুরো খবরটি একেবারেই বিভ্রান্তিমূলকভাবে পেশ করা হয়েছে। আসুন, আসল ঘটনা জেনে নেই।
আসল ঘটনার সূত্রপাত BCIT নামক কানাডিয়ান এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক মূল্যায়ন সার্ভিস ICES দ্বারা প্রকাশিত বাংলাদেশী কিছু প্রাইভেট ভার্সিটির লিস্ট , যেগুলা থেকে অর্জিত ডিগ্রি একাডেমিক্ ইকুইভ্যালেন্স করতে ICES অপারগতা প্রকাশ করেছে।
আমি খুব ভালো করেই জানি BCIT এর ব্যাপ্তি ও পরিসর সম্পর্কে। এই BCIT যে প্রভিন্সে সেই ব্রিটিশ কলম্বিয়াতেই আমি থাকি। কানাডার সেকেন্ড টপ ইউনিভার্সিটি UBC তে আমি পিএইচডি পড়াশুনা করতেছি। সেজন্যেই বললাম BCIT খুবই ছোট খাটো একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্রেফ কলেজ লেভেলের, কোনো ইউনিভার্সিটি নয় এটা। তাই একারণে তারা লিস্টে প্রদর্শিত বাংলাদেশী ভার্সিটি সূমহ থেকে অর্জিত ডিগ্রির একাডেমিক ইকুইভ্যালেন্স মূল্যায়ণহয়তো করতে পারছে না তাদের নিজেদের অপারেশনাল সীমাবদ্ধতার কারণে।
ICES ছাড়াও বহুল পরিচিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলিতে সকল বাংলদেশী প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট তাদের অর্জিত ডিগ্রি মূল্যায়ন করতে পারবেন: WES World Education Services (WES), ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর Comparative Education Service (CES), IQAS ইত্যাদি।
কমেন্ট বাদেও অনেকে নিজ নিজ ওয়ালে ,কিংবা নিজেদের পেজ/গ্রুপ থেকে এই দাবি খন্ডন করে পোস্ট দিতে থাকেন। যেমন- Study in Canada From Bangladesh নামক কনসাল্টিং এজেন্সির ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট দিয়ে জানানো হয়- সংবাদটি ভুল ও বিভ্রান্তিকর । উল্লেখিত যেই ৩৩ ইউনিভার্সিটি আছে, উক্ত প্রতিষ্ঠান এর সকল ছাত্র ছাত্রীদের কানাডা পড়াশোনা জন্য আবেদন করতে কোন ধরনের সমস্যা হবে না । আমরা রিসেন্টলি উল্লেখিত ইউনিভার্সিটির কয়েক জন্য স্টুডেন্ট এডমিশন ও ভিসা প্রসেস সম্পন্ন করিয়াছি।বাংলাদেশে উল্লেখিত ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা আগের মতোই স্বাভাবিক ভাবে কানাডা তে পড়াশোনা জন্য আবেদন ও ভিসা প্রসেস করতে পারবেন, কোন ধরনের সমস্যা হবে।
E-LearnEx নামের আরেকটি এডুকেশনাল রিসার্চ সেন্টার এর ফেসবুক গ্রুপে পাবলিক পোস্টে বলা হয়, এখানে পুরো খবরটা খুবই মিস লিডিং ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০১৬ এর দিকে আমাদের দেশের অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে UGC (University Grant Commission) এ আপডেটেড ইনফরমেশন ছিলো না। সেই সময় অনেক ইউনিভার্সিটির নিজেস্ব ক্যাম্পাস না থাকায় কিছু কিছু ইউনিভার্সিটিকে রেড লিস্টেড করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তার মাঝে অনেকের নিজস্ব ক্যাম্পাস হয় ও অন্যান্য শর্ত পূরণ হয় তখন সেগুলো অনুমোদিতহয়। ঠিক সে সময় ক্যানাডার ক্রেডেনশিয়াল এসেসমেন্ট বডিরা বাংলাদেশের সেই সকল রেড লিস্টেড ইউনিভার্সিটি গুলোকে ব্যান করে কিন্তু পরে সেই ব্যান তুলে নেয়া হয় শুধু মাত্র ICES অলসতা হোক বা অবহেলা হোক তারা সেটা আপডেট করেনি।
তাই আপনার যদি ECA করতে হয় আর আপনারা এই লিস্টের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে থাকেন আর আপনার ইউনিভার্সিটি UGC approved হয়ে থাকে তাহলে WES, CES, IQAS, ICAS এর মাঝে যে কোনও একটা থেকে করাতে পারেন কোনো সমস্যা নেই। তো আপনি চাইলে অন্য সংস্থার মাধ্যমেও আপনার সার্টিফিকেট মার্কশীট ECA করাতে পারেন।
সাইবার ’৭১ সহ আরো বেশ কিছু পেজ এবং গ্রুপ থেকে কানাডা গমনে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের এই গুজব সম্পর্কে সচেতন করা হয়।
১৮ই সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম কে উদ্ধৃত করে দি ডেইলি ক্যাম্পাস এবং দি রাইজিং ক্যাম্পাস নামক ওয়েব পোর্টালে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এখানে দিল আফরোজ বেগম বলেন, ‘প্রকাশিত তালিকাটি কানাডা সরকার অনুমোদিত কিছু নয়। তাই চিন্তার কারণ নেই। আর এছাড়াও তালিকায় ঢাকার উত্তরার ইউনিভার্সিটি অফ কুমিল্লার নাম রয়েছে, যেটি ইউজিসির দেয়া লাল তারকা চিহ্নযুক্ত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। তাই এ বিষয়ে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
প্রকাশিত খবরটিতে কানাডার একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় (ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইন্সটিটিউশন অফ টেকনোলজি)-এ বাংলাদেশের ৩৩ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সনদ মূল্যায়ণের অক্ষমতার কথা জানা যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের কোনো ঘাটতির কারণে হয়নি, বরং উক্ত কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার অভাবে ঘটছে। এছাড়া, উক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে কানাডার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের আলোচ্য ৩৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেতে কোনো বাধা নেই।
শিরোনামটি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক ,যে, কানাডার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাংলাদেশের উক্ত ৩৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তেমন নয়।
সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই সংবাদটিকে ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?