পাস্তুরিত দুধ বা “pasteurized milk” আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। বিক্রি করে বেশ কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। পাস্তুরিত দুধ কিন্তু মোটেও কাঁচা দুধ নয়! ১৮৬৪ সালে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী লুইস পাস্তোর আবিষ্কার করেন দুধকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত করে কয়েকদিন সংরক্ষণের একটি প্রক্রিয়া। পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়াটি পরিচিত হয় “পাস্তুরাইজেশন” নামে। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ-র ওয়েবসাইট অনুযায়ী, পাস্তুরিত দুধকে প্যাকেটজাত করার আগে কমপক্ষে ১৫ সেকেন্ডের জন্যে ১৬১.৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে আবার ঠাণ্ডা করে নেওয়া হয়। দুধকে উত্তপ্ত করা হয় যাতে এটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মুক্ত হয় এবং দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ফ্রিজারে সংরক্ষণ করা যায়।
স্বভাবতই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকে না, এমন ধারণার কারণে গোটা বিশ্বে পাস্তুরিত দুধ সরাসরি প্যাকেট থেকে ঢেলে বা অল্প কিছুক্ষণ গরম করে খাওয়ার একটি প্রবণতা রয়েছে। আমাদের দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মিত বিজ্ঞাপন এবং প্রামাণ্যচিত্রতেও কখনো বলা হয় না ফুটিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটি। বরং পাস্তুরিত দুধ যেভাবে করে খাওয়ার কথা সেভাবেই সরাসরি প্যাকেট থেকে খাওয়ার দৃশ্য দেখা যায় আড়ংয়ের বিজ্ঞাপন এবং মিল্ক ভিটার তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্রে।
এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, পাস্তুরিত দুধ বলতে আমাদের বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলি কি আন্তর্জাতিক মান বিবেচনা করে না ফুটিয়ে খাওয়ার যোগ্য?
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি)-র করা একটি গবেষণায় উঠে এসেছে পাস্তুরিত দুধ সংক্রান্ত ভয়াবহ কিছু তথ্য! আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা বাজারে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির দুধের নমুনা পরীক্ষা করে ৭৭ শতাংশে স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন। এসকল ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিই জানান দিচ্ছে যে পাস্তুরিত দুধের প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়ার কোথাও রয়েছে বেশ বড়সড় গলদ!
গবেষণাটিতে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, দুধ প্রতিনিয়ত নতুন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা অনেক বেশি দূষিত হচ্ছে খামার থেকে শুরু করে দোকানে বিক্রি হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে! কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা নমুনার পাশাপাশি দুধের আড়তে এবং হিমাগারে থাকা দুধেও কলিফর্ম এবং ফিক্যাল কলিফর্মের মতন ক্ষতিকর অনুজীবের উপস্থিতি পেয়েছেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা। আন্তর্জাতিক এনজিও কেয়ারের আর্থিক সহায়তায় আটজন বিজ্ঞানীর দলের করা এই গবেষণায় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি। শিশুপুষ্টির অন্যতম উৎস দুধে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ দেশের জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলো-কে বলেন, “১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কমপক্ষে ১৫ মিনিট ফুটিয়ে তার পর সেই দুধ খেতে হবে বা শিশুকে খাওয়াতে হবে।”
আমাদের দেশের জনপ্রিয় কিছু পাস্তুরিত দুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে চাইলে প্রথমেই আসে মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ এবং ফার্ম ফ্রেশের নাম। তাদের প্রত্যেকের বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে যে তাদের কেউই বিজ্ঞাপনে দুধ ফুটিয়ে খাবার কথা বলছে না। এমনকি দুধ ফোটানোর কোনপ্রকার দৃশ্যও থাকছে না কোন বিজ্ঞাপনে। প্রাণ দুধের একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় ডাইনিং টেবিলের উপর প্যাকেটজাত দুধের প্যাকেট থাকা অবস্থায় জগ থেকে গ্লাসে দুধ ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে আড়ং-এর বিজ্ঞাপনে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত একজন তপ্ত সুর্যের নিচে দাঁড়িয়ে তার পিপাসা মেটাতে সরাসরি প্যাকেট থেকে দুধ পান করছেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, আইসিডিডিআরবির প্রতিবেদনে পাস্তুরিত দুধের ব্যাপারে নেতিবাচক ফলাফল আসলেও ইউএইচটি মিল্কের যেসকল নমুনা গবেষণা চলাকালীন সংগ্রহ করা হয় সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গবেষক দল তাতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পায় নি। গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ডক্টর মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, “নমুনা হিসেবে থাকা ইউএইচটি মিল্ক সরাসরি প্যাকেট থেকে খাওয়া নিরাপদ।”
আইসিডিডিআরবি’র প্রতিবেদনের পর চলতি মাসের ২১ তারিখে বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ নিরাপদ কি না তা বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে পরীক্ষা করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। এক মাসের ভেতর নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে খাদ্য সচিব, স্বাস্থ্য সচিব ও বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালককে।