ফেসবুকে এই মর্মে একটি সংবাদ ছড়িয়েছে যে, ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালের পরে। তথ্যসুত্র হিসেবে গণমাধ্যম প্রথম আলোর নাম বলা হয়েছে। বিস্তর অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে প্রথম আলো থেকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে কোনো প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়নি যে, ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ এর পরে হয়েছে। যদিও ৮ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে প্রথম আলো থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম – “মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এটি ভুল, নাকি অনিয়ম”। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী ভাতাপ্রাপ্ত প্রায় দুই হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার বয়স ৫০–এর নিচে। অর্থাৎ এই দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী জন্ম নিয়েছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে প্রথম আলোর আর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম- “বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা ৫২ বছরেও হয়নি”। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং এ বিষয়ে নানা অসংগতি প্রথম আলোতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ এর পরে — এমন কোনো সংবাদ প্রথম আলো-তে পাওয়া যায় নি।
ভাতাপ্রাপ্ত প্রায় দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার বয়স ৫০ বছরের নিচে এই তথ্যটি সামনে এসেছিল কেননা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার (গেজেটভুক্ত) বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে হিসাবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হবে সাড়ে ৬১ বছর। অথচ যাচাই-বাছাই করে দেখা গিয়েছিল ৫০ বছরের নিচের ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন। বিস্তারিত দেখুন এখানে।
এ বিষয়ে সে সময়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলেছিল, প্রায় দুই হাজার জনের বয়স ৫০ বছরের কম হওয়ার কারণ কী, তা তদন্ত করে দেখা হবে। অপরদিকে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেছিলেন, দু-একজনের নাম ভুল হতে পারে। এতজনের বয়সের তথ্য ভুল হওয়ার বিষয়টি সাধারণ ব্যাপার নয়। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের জানার কথা নয় কার বয়স কত। জন্মসনদ, নাগরিকত্ব সনদসহ যেসব কাগজপত্র দেওয়া হয়, তার ভিত্তিতেই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়। অনেকেই চাহিদা অনুযায়ী বয়স কমান, বাড়ান। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে একজনের কাগজ আরেকজন ব্যবহার করে জালিয়াতি করতে পারেন। যদি মন্ত্রণালয় তালিকা পাঠায়, তাহলে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
তাছাড়া ২৬ মার্চ ২০২৩ তারিখে “বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা ৫২ বছরেও হয়নি” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের বিস্তারিত অংশ থেকে জানা যাচ্ছে,
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এই তালিকা তৈরির আইনগত কর্তৃত্ব জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা)।
তারা প্রায় প্রতিটি বৈঠকে (মাসে) বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন কারও নাম অন্তর্ভুক্ত করছে, নয়তো আগের তালিকা থেকে কাউকে বাদ দিচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা থেকে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মোট ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭ জনের নাম বিভিন্ন সময়ে গেজেটভুক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা তথ্যমতে, ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি অপূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকার প্রকাশ করেছিল। ফলে দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কত, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
অর্থাৎ, প্রথম আলো থেকে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে দেশে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা কতো তার একটি ধারণা পাওয়া গেছে। তাছাড়া প্রায় দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের পরে জন্ম নিয়েছেন তা জানা গেছে।
এছাড়া ০৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে যুগান্তর থেকে “গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: যাচাই হবে ৫৫ হাজার সনদ” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনের বিস্তারিত অংশ থেকে জানা যাচ্ছে, গেজেটভুক্ত প্রায় ৫৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার সব ধরনের তথ্য ফের যাচাই-বাছাই করা হবে।
এসব মুক্তিযোদ্ধা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে (২০০২-১৪) তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু সেই সময় ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০০২’ অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। এসব বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই কমিটির কাছে নিজেদের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলে তাদের গেজেট বহাল থাকবে। অন্যথায় গেজেট সনদ বাতিলের পাশাপাশি ভাতাও বন্ধ হবে।
এ পর্যায়ে ১৮ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে বিবিসি বাংলা থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রায় আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করেছে। যদিও প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নেয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। এমনকি তাদের মধ্যে যারা সরকারি ভাতা গ্রহণ করেছে সেই টাকাও ফেরত আনার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বিবিসি বাংলার উক্ত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৩ হাজারের সামান্য বেশি।
বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে। এমনকি বাংলাদেশে ভুয়া বা অ-মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ঠিক কত, সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কার তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে একাধিক বিতর্ক থাকলেও ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ এর পরে হয়েছে এমন কোনো সংবাদ জাতীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো বা অন্য কোনো গণমাধ্যম থেকে প্রকাশিত এ বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তাই এমন দাবিকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” সাব্যস্ত করেছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।