‘’দেশে 5G পরিসেবা চালু হলে ,পশু পাখি এবং গাছপালার প্রচুর ক্ষতি হবে। এতে অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দেবে’’- এমন দাবি এবং বলিউড অভিনেত্রী জুহি চাওলার ছবি সম্বলিত পোস্টারটি গত ৩ই জুন ২০২১ ভারতীয় পেজ হ্যাপি লেস এ দেখা যায় । অনেকে এই ছবি শেয়ার করতে থাকেন। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে- বলিউড অভিনেত্রী জুহি চাওলা ভারতের আদালতে 5G প্রযুক্তির প্রয়োগের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। তার দাবি ছিল, ফাইভ-জি প্রযুক্তি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। আদালত তার সেই মামলা খারিজ করে দিয়েছেন এবং জুহি চাওলাকে ২০ লক্ষ রুপি জরিমানা করেছেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মামলার রায়ে বলেছে– ‘’জুহির করা এই মামলার কোনও যৌক্তিকতা নেই। অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল’’।
মূল উৎস
Happy Less পেজ থেকে এই পোস্টারটি ১৫ হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে। হ্যাপি লেস ছাড়াও ফেসবুকের আরো কয়েক জায়গায় এটি দেখা যাচ্ছে। (যেমন-এখানে এবংএখানে ।) তবে সবাই হ্যাপি লেস থেকেই ছবিটি গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
মূলত ভারতের ইস্যু হলেও বাংলাদেশেও এই গুজব ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। গত ৮ই জুন Science lovers BD নামক ফেসবুক গ্রুপেওএই ছবি দেখা যায়।
সোশ্যাল মনিটরিং প্লাটফর্ম ক্রাউডট্যাঙ্গল এর তথ্য অনুযায়ী ফেসবুকে এ ধরণের পোস্টের সংখ্যা কমপক্ষে ৬৬ টি যেগুলো ইতোমধ্যে প্রায় ৭৮,০০০ এর বেশি প্রতিক্রিয়া পেয়েছে।
5G কতটা ক্ষতিকর ?
মোবাইলের 5G Technology ইতিমধ্যেই চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটা দেশে চালু হয়েছে।
বিভিন্ন জায়গায় ফাইভ-জি কে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে দাবি করে কেউ কেউ আন্দোলন করছেন। তবে বেতার তরঙ্গের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিরূপণের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন নন–আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রোটেকশন (আইসিএনআইআরপি) ফাইভ জি কেনিরাপদ বলে ঘোষণা করেছে।
কিন্তু তারপরও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই মাঝে মাঝেই ফাইভ জি নিয়ে গুজব শোনা যায়।
২০১৮ সালেগুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে নেদারল্যান্ডসে একটি ফাইভ জি টাওয়ার টেস্ট করতে গিয়ে শত শত পাখি মারা গিয়েছে । সে সময়ে ফ্যাক্ট চেকাররা এই গুজবটাযাচাই করেছিল ।
২০২০ সাল থেকে নতুন গুজব ছড়িয়েছিল- ফাইভ জি নেটওয়ার্কের কারণেই নাকি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে কয়েকটা কনস্পিরেসি থিওরি গ্রুপ বিশ্বের বিভিন্ন শহরেবিক্ষোভ এবং হামলা ভাংচুর চালিয়েছিল । নেদারল্যান্ড ,আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, সুইডেন, বেলজিয়াম, ইটালি, ক্রোয়েশিয়া সহ অনেক দেশেই বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে।
২০২০ সালের NCBI এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, 5g টেকনোলজি বা মোবাইলের রেডিয়েশন কেবলমাত্র মানবকোষের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা স্বল্প পরিমানে বাড়াতে পারে। তবে ক্যান্সার বা অন্য গুরুতর অসুখ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ,WHO বলছে, ওয়্যারলেস টেকনোলজির কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায় নি। তবে এ নিয়ে কেবলমাত্র অল্প কয়েকটি গবেষণাই সম্পন্ন হয়েছে (“no adverse health effect has been causally linked with exposure to wireless technologies . But only a few studies have been carried out at the frequencies to be used by 5G.”)
বড় পরিসরে সাম্প্রতিককালে WHOএকটি গবেষণা শুরু করেছে “A health risk assessment from exposure to radio frequencies, covering the entire radiofrequency range, including 5G.” শিরোনামে। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হবে ২০২২ সালে।
ইলেট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠন , IEEE এর সিনিয়র মেম্বর এবং IEEE Future Initiative এর কো-চেয়ারম্যান David Witkowski এক সাক্ষাতকারে বলেছেন , ”৬০ বছর আগে ইলেক্টোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রথম গবেষণা শুরু হয় । তারপর থেকে হাজার খানেক গবেষণা প্রতিবেদন বের হয়েছে। অধিকাংশ গবেষণাতেই দেখা গিয়েছে, ফাইভ-জি ব্যবহারে কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। কিছু গবেষণা অবশ্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীন থেকেছে। অল্প কয়েকটা গবেষণায় কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু সেই ফলাফলের পুনরাবৃত্তি একই ধরনের অন্যান্য গবেষণায় পাওয়া যায়নি। তাই সেই ফলাফল গ্রহণযোগ্য হয়নি।“
অতএব, 5G পরিসেবা চালু হলে, পশু-পাখি এবং গাছপালার প্রচুর ক্ষতি হবে । এতে অক্সিজেন সংকট দেখে দেবে — এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছেনা।
গত ২রা জুন বলিউডের অতিনেত্রী জুহি চাওলা ভারতের সুপ্রিম কোর্টেমামলা করেছিলেন ভারত সরকারের 5G পরিসেবা সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে । আদালততার রায়ে বলেছে, “জুহির করা এই মামলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।“ আদালত জুহি চাওলা কে ২০ লক্ষ টাকাজরিমানাও করেছে।
জুহি অবশ্য মামলার পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, 5G টেকনোলজি নিয়ে আমাদের করা মামলার ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আমরা 5G স্থাপনের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আমরা চাই প্রশাসন অন্তত এটুকু নিশ্চিত করুক যে 5G টেকনোলজি স্থাপন দেশের মানুষের পক্ষে ও জীববৈচিত্র্যের জন্য নিরাপদ কিনা।
জুহি চাওলার তারকাখ্যাতির কারণে এ ধরনের তথ্য অনেক মানুষ নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এই দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখন পর্যন্ত নেই।
বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যে 5G টেকনোলজি গ্রহণ করেছে, অনেকে এটি চালু করার পথে। আবার কয়েকটা দেশ একটু ধীরে-সূস্থে এই প্রযুক্তির পথে অগ্রসর হতে চাচ্ছে। কিন্তু এটি মানবদেহ বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর-এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ফলে, ফ্যাক্টওয়াচের রায়ে এটি একটি অসত্য দাবি।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?