‘গবেষণা বলছে দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান আয়ু বাড়াবে’ – এমন শিরোনামে একটি পোস্ট সম্প্রতি পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে যে, মূল গবেষণায় পানির নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করা হয় নি, শুধুমাত্র “পর্যাপ্ত হাইড্রেশন” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও পোস্টে বলা হয়েছে এ গবেষণাটি ৩০ বছরের বেশি বয়সের ১১,২৫৫ জন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করে করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ৩০ বছরের বেশি বয়স নয়, বরং ৩০ বছর সময়কাল ধরে ১১,২৫৫ জন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টকে বিভ্রান্তিকর আখ্যা দিচ্ছে।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে মূল খবরটি তাদের সূত্র হিসেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদপত্র ডেইলি মেইল (Daily Mail) -কে ব্যবহার করেছে। ডেইলি মেইলের মূল প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায় যার শিরোনাম হলো – Secret to anti-aging: Drinking eight glasses of water every day can prolong your life for up to 15 years and slash the risk of heart attacks, strokes and dementia, study suggests.
শিরোনামে ৮ গ্লাস পানি পানের উল্লেখ থাকলেও মূল সংবাদে কিন্তু গবেষণার বরাতে বয়সবৃদ্ধিকে বিলম্বিত করতে ঠিক কতোটুকু পরিমাণ পানি পান করতে হবে — তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় নি।
এদিকে মূল গবেষণাপত্রতে পানির পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য খুঁজতে গিয়ে শুধুমাত্র ‘Optimal hydration’ (পর্যাপ্ত হাইড্রেশন) টার্মটি পাওয়া যাচ্ছে। পানির পরিমাণ হিসেবে ৮ গ্লাস এমনকি লিটার, মিলিলিটার বা অন্য একক উল্লেখ করা হয় নি।
এ গবেষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট National Institutes of Health (NIH) , যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম CNN এবং USA Today যে প্রতিবেদনগুলো করেছে সেগুলোর শিরোনাম কিংবা মূল সংবাদ কোনোটিতেই ৮ গ্লাস পরিমাণ পানির কথা উল্লেখ নেই। প্রতিবেদনগুলো পর্যাপ্ত হাইড্রেশন টার্মটি ব্যবহার করেছে।
স্পষ্টতই, ডেইলি মেইল পত্রিকার শিরোনাম এবং উক্ত পোস্টের শিরোনামসহ মূল সংবাদটি বিভ্রান্তিকর।
Snopes এবং The New York Times – এর ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে, পানিশূন্যতা এড়াতে দৈনিক ৮ গ্লাস পানি খাওয়ার বিষয়টি আসলে একটি মিথ। এই মিথের উৎপত্তি কোথা থেকে সেটি বেশিরভাগ পুষ্টিবিদের ধারণা নেই। চিকিৎসাবিদ এবং গবেষকদের মতে দৈনিক ঠিক ৮ গ্লাস পানি পান করতে হবে – এ আবশ্যকতার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। খাদ্য ও পুষ্টি অধিদপ্তরের ১৯৪৫ সালের পরামর্শ অনুযায়ী একজন মানুষের দৈনিক আড়াই লিটার পানির চাহিদা থাকে। প্রতিদিনকার খাবার, ফল, চা, কফি, জুস থেকে এই আড়াই লিটার পানির উল্লেখযোগ্য অংশের সরবরাহ পাওয়া যায়। । এক গ্লাস চা, জুস, দুধ এবং সোডা এক গ্লাস পানির সমপরিমাণ হাইড্রেশন দিতে সক্ষম।
স্বাস্থবিষয়ক আরেকটি নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট Healthline-এর এই প্রতিবেদনটিও ৮ গ্লাস পানি খাওয়ার বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন বলছে। তারা পরামর্শ দিয়েছে, দেহে পানির প্রয়োজনীয়তা জানান দেয় তৃষ্ণা, তাই তৃষ্ণা নিবারণে পানি পান করাই যথেষ্ট।
আরেকটি স্বনামধন্য পত্রিকা The Washinton Post-ও ৮ গ্লাস পানি খাওয়ার বিষয়টিকে খারিজ করে দিচ্ছে এবং জানাচ্ছে, একজন মানুষের দৈনিক কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন তা নির্ভর করে তার দেহের আকার, ওজন, দেহে চর্বির পরিমাণ, কাজ ও পেশার ধরন, জলবায়ু, বয়স ও লাইফস্টাইলের ওপরে।
তাই ধরে নেয়া যায়, ডেইলি মেইল এবং উক্ত পোস্টের দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পানের ধারণাটি এ মিথ থেকেই এসেছে।
আরও একটি বিষয় হলো, এই পোস্টের মূল সংবাদে বলা হয়েছে – ৩০ এর বেশি বয়স্ক মোট ১১ হাজার মানুষের রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা ট্র্যাক করা হয়েছে এই গবেষণায়। সংবাদের সূত্র ডেইলি মেইলও একই কথা বলছে। কিন্তু NIH-এর প্রতিবেদন বলছে – Using health data gathered from 11,255 adults over a 30-year period, researchers analyzed links between serum sodium levels. অর্থাৎ ৩০ বছর সময়কাল ধরে ১১,২৫৫ জন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করে গবেষকরা সিরাম সোডিয়াম লেভেলের সাথে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন। CNN এর প্রতিবেদনও একই কথা বলছে।
মূল গবেষণাপত্র যাচাই করেও এর সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ডাটা সংগ্রহের সময়কাল দেখুন যা বলছে এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় ৩০ বছর ধরে। অথচ পোস্টে লেখা হয়েছে ৩০ এর কম বয়সীদের তথ্য নিয়ে নাকি গবেষণাটি করা হয়েছে!
তাই সার্বিক বিবেচনায় উপযুক্ত প্রমাণসাপেক্ষে ফ্যাক্টওয়াচ এ পোস্টকে বিভ্রান্তিকর সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?