ফেসবুকে যা ছড়াচ্ছেঃ ১৫ আগস্ট ২০২৪ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত তার স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে এক ব্যক্তি লাঞ্ছনার শিকার হন। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে দাবি করা হয় ওই ব্যক্তি ক্ষোভে, অপমানে, ঘৃণায় হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন।
আসল ঘটনাঃ দাবিটি মিথ্যা। হেনস্তার শিকার হওয়া ওই ব্যক্তির নাম আবদুল কুদ্দুস মাখন। তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যাননি, বেঁচে আছেন। আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং তার বড় ছেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মূলত, আসিফ তালুকদার নামের এক ব্যক্তি তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ১৫ আগস্ট ২০২৪-এ আবদুল কুদ্দুস মাখনের লাঞ্ছিত হওয়ার একটি ভিডিও শেয়ার করে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আসিফ তালুকদার এই ভিডিওর ক্যাপশনে উল্লেখ করেছিলেন তার বাবা বেঁচে নেই। তবে, ঘটনাটি ন্যায়সঙ্গত কি না এটা যাচাই করার জন্য ভুক্তভোগী ব্যক্তির স্থানে যার যার বাবা বেঁচে আছেন তাদেরকে বসিয়ে বিচার করতে বলেছিলেন। তার এই ক্যাপশনকে ভুল ব্যাখ্যা করে আসিফ তালুকদারকে ভুক্তভোগীর ছেলে ধরে নিয়ে তার এই পোস্টকে কেন্দ্র করে দাবি করা হচ্ছে যে, আবদুল কুদ্দুস মাখন মারা গেছেন। পরবর্তীতে আসিফ তালুকদার নিজেই এই বিভ্রান্তি এড়াতে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেকটি পোষ্ট করে নিশ্চিত করেন যে, আবদুল কুদ্দুস মাখন তার বাবা নয়।
১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যুবার্ষিকীতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত তাঁর স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ খবরে বিক্ষুব্ধ কিছু ছাত্র-জনতা ৩২ নম্বর এলাকায় লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয়। ১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেওয়ার জন্য কেউ এলে তাদেরকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছিল। শ্রদ্ধা জানাতে আসা কয়েকজন লাঞ্ছনা এবং মারধরের শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে দুর্বৃত্তদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়া এমন এক ব্যক্তির বেশ কিছু ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে। যার মধ্যে কিছু ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হচ্ছে ওই ব্যক্তি ক্ষোভে, অপমানে, ঘৃণায় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ভিডিওগুলোতে লাঞ্ছিত ব্যক্তির মারা যাওয়া সম্পর্কিত তথ্যের উৎস হিসেবে আসিফ তালুকদার নামের এক ব্যক্তির একটি পোস্ট ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুরুতেই আসিফ তালুকদারের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি খোঁজার চেষ্টা করে ফ্যাক্টওয়াচ টিম। পরবর্তীতে, আসিফ তালুকদারের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার আলোচিত পোস্টটির পরবর্তি সংস্করনের একটি পোষ্ট খুঁজে পাওয়া যায়। আসিফ তালুকদার তার এই পোস্টের ক্যাপশন তিনবার সম্পাদনা করেছেন। এই পোস্টের এডিট হিস্টোরি অনুসন্ধান করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
তার এডিট হিস্টোরির প্রথম এবং দ্বিতীয় খসড়াটি খেয়াল করলে দেখা যাবে আসিফ তালুকদার মূলত বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, তার বাবা বেঁচে নেই। তবে, ঘটনাটি ন্যায়সঙ্গত কি না এটা যাচাই করার জন্য ভুক্তভোগী ব্যক্তির স্থানে যার যার বাবা বেঁচে আছেন তাদেরকে বসিয়ে বিচার করা উচিত। কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ না থাকায় অনেকেই আসিফ তালুকদারকে ভুক্তভোগীর ছেলে হিসেবে ধরে নিয়েছেন। পাশাপাশি, তার এই পোস্টকে কেন্দ্র করে দাবি করছেন যে ভুক্তভোগী মারা গেছেন। তৃতীয় ড্রাফটে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তার বাবা ২০২২ সালে মারা গেছেন। অর্থাৎ, এর মাধ্যমে এতটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভুক্তভোগী আসিফ তালুকদারের বাবা নয়।
এরপরে, প্রাসঙ্গিক কিছু কি-ওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করে যুগান্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ১৬ আগস্ট ২০২৪ এ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সম্পর্কে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে, ভুক্তভোগীর নাম আব্দুল কুদ্দুছ মাখন। এই প্রতিবেদনে সিরাজ উল কুদ্দুছ ইমরান নামের এক ব্যক্তিকে বরাত দিয়ে উল্লেখ করা যে আব্দুল কুদ্দুছ মাখন জীবিত আছেন। এছাড়াও এই প্রতিবেদনে সিরাজ উল কুদ্দুছ ইমরানকে আব্দুল কুদ্দুছ মাখনের বড় ছেলে বলা হচ্ছে।
এই সূত্র ধরে সিরাজ উল কুদ্দুছ ইমরানের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুঁজে পায় ফ্যাক্টওয়াচ টিম। সেখানে তিনি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর একটি স্ক্রিনশট এবং ভুক্তভোগীর একটি ছবি ব্যবহার করে একটি পোষ্ট আপলোড করেন। এই পোস্টের ক্যাপশনে তিনি উল্লেখ করেন যে, ভিডিওতে যাকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তার নাম আব্দুল কুদ্দুছ মাখন যিনি জীবিত আছেন। তিনি হচ্ছেন ভিডিওতে দেখানো ভুক্তভোগীর বড় ছেলে। সিরাজ উল কুদ্দুছ ইমরানের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আপলোড করা কিছু পারিবারিক ছবিতেও আব্দুল কুদ্দুছ মাখনকে দেখতে পাওয়া যায়। আব্দুল কুদ্দুছ মাখনের ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও সিরাজ উল কুদ্দুছ ইমরানের ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, ঢাকা পোস্ট ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার সড়কের ঘটনার ব্যাপারে আবদুল কুদ্দুস মাখনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন,
“আমি প্রতিবছর শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি ৩২-এ তার বাসভবনে যাই। গতকাল সকালে আমি আমার বাসা থেকে বের হয়ে ধানমন্ডি ৩২-এ গেলে আমার ওপর তারা হামলা করে এবং অনেক মারধর করে। আমি বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক। বর্তমানে আমার কোনো পদবি নেই। আমি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে ২০০৭ সালে বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ নামে একটি সংগঠন করেছিলাম। আমরা এরমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্মৃতিচারণ করতাম। আমি ওই সংগঠনের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম, পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছি। আমি ৯০-র দশকে ময়মনসিংহ পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। এটা আমাকে দিয়েছিলেন আলহাজ মতিউর রহমান প্রিন্সিপাল। আমি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির লালন করি। আমাকে যারা গতকাল লাঞ্ছিত করেছে আল্লাহ সবার সঠিক বিচার করবেন। আর আমি জীবিত আছি, ভালো আছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।”
দেখা যাচ্ছে যে, ‘ফেসবুকে দেখানো হেনস্তার শিকার হওয়া ব্যক্তিটি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন’ এই দাবিটির সমর্থনে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া উপরে উল্লেখিত সকল প্রমাণগুলো এই দাবিটির সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।