মাথায় ইটের আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয় নি

173
মাথায় ইটের আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয় নি
মাথায় ইটের আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয় নি

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হননি। পিছন থেকে ছোঁড়া ইটের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এমন দাবির স্বপক্ষে আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের একটি কপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দাবি অনুযায়ী ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে নাকি এ কথা উল্লেখ রয়েছে যে মাথায় আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। বলাই বাহুল্য আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি পরিষ্কার করে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ছররা গুলির আঘাতে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন আবু সাঈদ। তাছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কোথাও তিনি এ কথা উল্লেখ করেননি যে, মাথায় আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। বরং মাথায় আঘাতের চিহ্ন আছে, কিন্তু সেটি মৃত্যুর কারণ নয়।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

বিস্তারিত:

২৭ জুলাই ২০২৪ তারিখে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পুলিশের প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিলো না। এফআইআরে বলা হয়েছিল, বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন দিক থেকে গুলি ছুড়তে থাকে এবং ইটের টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে। এক পর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখা যায়। সহপাঠীরা উক্ত শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অর্থাৎ আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে শুরুতেই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। সে সময়ে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় প্রকাশিত ভিডিও যাচাই করেছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সেখানে দেখা যায় অন্তত দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে তাকে লক্ষ্য করে ১২-গেজ শটগান থেকে সরাসরি গুলি ছোড়েন। সে সময় সাঈদ তার বুক চেপে ধরেন এবং পুলিশ কর্মকর্তা কমপক্ষে আরও দুবার গুলি চালান। এরপরে রাস্তা পার হয়ে আবু সাঈদ পড়ে যান। আবু সাঈদের সহপাঠীরা তাৎক্ষনিকভাবে জানিয়েছিলো নিজেদের অপরাধ ঢাকতে গুলিতে মৃত্যুর বিষয়টি চেপে যাচ্ছে পুলিশ।

এ পর্যায়ে আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলামের পুরো বক্তব্য জানা যাক। কেননা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন এই চিকিৎসক।

সামাজিক মাধ্যমে যখন আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয় মাথায় আঘাতের কারণে মারা গেছেন আবু সাঈদ। বিষয়টি দেখার পরে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয় বস্তু হলো না বুঝেই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কোথাও উল্লেখ নেই যে, মাথায় আঘাতের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। তবে আবু সাঈদের মাথায় আঘাতের চিহ্ন আছে, কিন্তু সেটি তার মৃত্যুর কারণ নয়। মাথায় অভ্যন্তরীণ কোনো রক্তক্ষরণ হয়নি। এমনকি তার মাথায় কোনো হাড় ভাঙা বা ফ্রাকচারও ছিল না। আঘাতটা থেতলে যাওয়ার মতো কিছুটা, পড়ে গিয়ে বা আঘাতে হতে পারে। এটা মেজর হেড ইনজুরি মনে হয়নি। হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হলে ব্রেইনে রক্তক্ষরণ হতো, যেটা সাঈদের ক্ষেত্রে হয়নি। রিপোর্টেও কোথাও বলা হয়নি ব্রেইনে রক্তক্ষরণ বা ফ্র্যাকচারের বিষয়ে। আমরা তার শরীর পুরোটা খুঁটিয়ে দেখেছি। বরং অসংখ্য ছররার গুলির আঘাতে আবু সাঈদের শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয় এবং তার অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া, আবু সাঈদ ডান পায়ে হাত দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। তার ডান উরুতেও ছররা গুলি লেগেছি। সেখানে ফিমোরাল আর্টারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়। তলপেটেও গুলির আঘাত ও রক্তক্ষরণ পেয়েছি। এসব আঘাতের কারণে শক ও রক্তক্ষরণের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে।

এই চিকিৎসক এটিও জানিয়েছেন যে, আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মাথায় আঘাতের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল, যেন জনসমক্ষে এটি প্রকাশ পায় যে তিনি মাথায় আঘাতের কারণে মারা গেছেন। প্রতিবেদনটি বেশ কয়েকবার চাপ দিয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। পুলিশের কথামতো প্রতিবেদন তৈরি করতে তাকে প্রলোভন ও ভয়ভীতিও দেখানো হয়েছে। অবশেষে গত ৩০ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল ও গৃহীত হয়েছে। তিনি সঠিক প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণে যা পেয়েছেন তাই উল্লেখ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি অর্থাৎ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন নিয়ে আদালতে তার বক্তব্য জানাবেন।

সুতরাং সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইটের আঘাতে নয়, আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের ছররা গুলিতে হয়েছে।

No Factcheck schema data available.

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে

এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে
ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh