অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বাইকের পিছনে কি তার স্ত্রী ছিলেন?

17
অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বাইকের পিছনে কি তার স্ত্রী ছিলেন? অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বাইকের পিছনে কি তার স্ত্রী ছিলেন?

Published on: [post_published]

সম্প্রতি “টিপকান্ডে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের স্ত্রীর বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হলো কেন?” এমন শিরোনামে প্রায় ৫ টি দাবিসম্পন্ন একটি পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে মূল দাবিটি হচ্ছে যে, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য নাজমুল তারেকের গর্ভবতী স্ত্রী তার বাইকের পিছনের আসনে বসা ছিলেন। কিন্তু অনুসন্ধানে এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি উক্ত দাবির সাথে যে ছবিটি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানেও তার বাইকের পিছনে কাউকে সনাক্ত করা যায়নি। মূলধারার গণমাধ্যমে থাকা ভাইরাল সিসিটিভি ফুটেজের ছবিতে উক্ত ব্যক্তির বাইকের পিছনে কাউকে দেখতে পাওয়া যায়নি। বরং সাংবাদিক হারুন-উর-রশিদের ভ্যারিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে পাওয়া একটি সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানা যায় সেসময় অভিযুক্ত ব্যক্তিটি বাইকে একাই ছিলেন। বাংলা ট্রিবিউন ও একাত্তর টিভিও জানায় তার বাইকের পিছনে সেসময় কেউ ছিলেন না। তাই মূলধারার গণমাধ্যমে থাকা ছবি এবং ভিডিওর উপর ভিত্তি করে ফ্যাক্টওয়াচ দাবিটিকে “মিথ্যা” সাব্যস্ত করছে।

 

এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

 

ভাইরাল দাবি

“টিপকাণ্ডে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের গর্ভবতী স্ত্রীর বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হলো কেন ?

.
টিপকাণ্ডে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য নাজমুল তারেকের গর্ভবর্তী স্ত্রী বাইকের পেছনে বসে ছিলেন, সিসিটিভির ফুটেজে যা স্পষ্ট। কিন্তু সেই গর্ভবতী নারীর বিষয়টি কেন এড়িয়ে যাওয়া হলো ? অভিযোগকারী লতা সমাদ্দার থানায় যে অভিযোগ করেছেন, সেখানে কোথাও উল্লেখ করেননি, পুলিশ সদস্যের গর্ভবতী স্ত্রীর কথা। অথচ পুলিশ সদস্য লতা সমাদ্দারের বাকবিতণ্ডার সূচনাই হয় পুলিশ সদস্যের গর্ভবর্তী স্ত্রীর পায়ের সাথে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে।

.
লতা সমাদ্দার তার অভিযোগে মটর সাইকেলের নম্বর উল্লেখ করলেন , পুলিশ সদস্যের মুখে দাড়ির কথা উল্লেখ করলেন, বয়সের বিষয়টি উল্লেখ করলেন, চিকন না মোটা সেটাও উল্লেখ করলেন, কিন্তু পেছনে বসা গর্ভবতী নারীর কথা কেন উল্লেখ করলেন না ? এটা অবশ্যই একটা যৌক্তিক প্রশ্ন।

.
আমার ধারণা লতা সমাদ্দার ভেবেছিলেন, যদি পেছনে বসা গর্ভবর্তী নারীর কথা উল্লেখ করা হয়, তবে ইস্যুটা সেভাবে জমানো যাবে না, বরং গর্ভবর্তী নারীর দিকে সবার সেন্টিমেন্ট ঝুঁকে পড়বে।
তাই তিনি সেটা না করে মোড় ঘুড়িয়ে দিলেন টিপ বনাম দাড়ির দিকে।
অর্থাৎ একদিকে হিন্দুমুসলিম সাম্প্রদায়িক ইস্যু, যেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘ্রাণ আছে।
আরেকটা দিক হলোনারীর পোষাকের প্রতি মৌলবাদীদের (দাড়িওয়ালাদের) সহিংসতা।

.
লতা সমাদ্দার যেহেতু মিডিয়া থিয়েটার স্টাডি বিভাগের শিক্ষিকা, সেহেতু তার সাথে অবশ্যই অনেক মঞ্চ বা পর্দা অভিনেতাদের সাথে যোগাযোগ আছে। তিনি সেই অভিনেতাঅভিনেত্রীর সিন্ডিকেট ব্যবহার তার ইস্যুটা ভাইরাল করেছেন। প্রথমে এক অভিনেত্রীকে দিয়ে সংসদে আলোচনা করিয়েছেন, অতঃপর অভিনেতাঅভিনেত্রী সবাইকে টিপ পরিয়ে নিজের পক্ষে আন্দোলনে নামিয়েছেন।
কথা হচ্ছে, তিনি সিন্ডিকেট শক্তি ব্যবহার করে এতগুলো মানুষকে আন্দোলনে নামালেন, কিন্তু নিজের মূল অভিযোগের ক্ষেত্রে পিউরিটি রক্ষা করলেন না, এটা কেমন অবস্থান হলো ?

.
আমি লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিমদের মনের ভেতর যতটুকু না সাম্প্রদায়িকতা আছে, তার থেকে ঢের লুকিয়ে আছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভেতরে। হিন্দুরা তাদের সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করে কিভাবে মুসলমানদের সুযোগ বুঝে ল্যাং মারবে শুধু সেই তালে থাকে।
গ্রাম অঞ্চলে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে দেখেছি পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছে, প্রতিবেশী মুসলমানরা নাকি তাদের মন্দির ভেঙ্গেছে। এই কথা শুনে পুলিশ মুসলমানকে গ্রেফতার করে জেলে ভরেছে। কিন্তু পরে ঘটনা তদন্ত দেখা যায় ভিন্ন, দ্বন্দ্বটা আসলে জমিজমা কেন্দ্রীক। হিন্দু নিজেই নিজের মন্দির ভেঙ্গে মুসলমানকে ফাঁসিয়ে জেলে ভরেছে জমির উপর কর্তৃত্ব নিতে। সাম্প্রদায়িক ইস্যু সাজিয়েছে শুধু মুসলমানকে ফাঁসাতে, অন্য কারণ নয়। ঠিক একইভাবে, লতা সমাদ্দার শহুরে শিক্ষিত শ্রেণী হতে পারেন, একজন কলেজ শিক্ষিকা হতে পারেন, কিন্তু মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা সেই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প তার যায়নি। ঘটনাই তার প্রমাণ।“

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

প্রথমেই ভাইরাল পোস্টে থাকা ছবির সাহায্যে রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হয়। কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া না গেলে পরবর্তীতে কিওয়ার্ডের মাধ্যমে পুনরায় অনুসন্ধান করা হলে, প্রথম আলো প্রকাশিত ০৪ এপ্রিল ২০২২ এর একটি প্রতিবেদনে এই ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।টিপ পরা নিয়ে নারীকে হেনস্তায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য বরখাস্তশিরোনামে এই প্রতিবেদনে ছবির সূত্র হিসেবেসংগৃহীতউল্লেখ করা হয়।

এছাড়া একই ছবি পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেকের পরিচয়ে বাংলা ট্রিবিউন এবং চ্যানেল আইয়েও দেখতে পাওয়া যায়। যদিও ছবিটির মূলসূত্র কেউই নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি।

প্রতিবেদনগুলো দেখুন এখানে এবং এখানে

মূলত এই ছবিরই নির্দিষ্ট একটি জায়গাকে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে চিহ্নিত করে ভাইরাল এই পোস্টগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

উপরোক্ত চিহ্নিত জায়গাটিকেস্পষ্টতইঅভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর শরীরের অংশ বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু ছবিটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে একটি হলুদ অংশবিশেষ ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। এই হলুদ অংশবিশেষটি কি আসলেই অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর দেহের অংশ কি না তা সম্পর্কে কোনো ধারণা করা যায় না। 

এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পুনরায় অনুসন্ধান করা হলেও দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে এমন দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

এই বিষয়ে হারুন উর রশিদ নামে একজন সাংবাদিকের ভ্যারিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে একটি সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত হলুদ অংশটিকে নাজমুল তারেকের স্ত্রী নয় বরং একটি হলুদ ব্যাগ দাবি করে মিনিট সেকেন্ডের এই ভিডিওটি এপ্রিল ২০২২ আপলোড করা হয়।

উপরোক্ত ভিডিওটিতে উল্লেখিত তারিখ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটি শনিবার, এপ্রিল ২০২২ এর ভিডিও। সময় হিসেবে সকাল টা বেজে ০৯ মিনিট উল্লেখ করা আছে। 


প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভুক্তভোগী লতা সমাদ্দার গত শনিবার সকাল ০৮ টা ২০ মিনিট সাড়ে ৮টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে বলে নিশ্চিত করেন। ঘটনাটি শনিবার সকালে ঘটেছে বলে বিবিসির এই প্রতিবেদনেও নিশ্চিত করা হয়।

অন্যদিকে ভিডিওটির স্থান হিসেবে সেখানে থাকা সাইনবোর্ড লক্ষ্য করলে দেখা যায় এটি ফার্মগেট, মনিপুরীপাড়ার। ভুক্তভোগীর মতে ঘটনাটি ফার্মগেট এলাকার সেজান পয়েন্টে ঘটেছে। গুগল ম্যাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মণিপুরী পাড়া এবং সেজান পয়েন্ট প্রায় কাছাকাছি এলাকা।


ভিডিওতে থাকা ব্যক্তি এবং মূলধারার গণমাধ্যমে পাওয়া নাজমুল তারেকের অবয়বের মধ্যে যথেষ্ট মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিও থেকে পাওয়া ছবি থেকে বুঝা যায় যে, উক্ত বাইকে নাজমুল তারেক একাই ছিলেন। পিছনের হলুদ অংশটি তার ব্যাগ বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত কোনো মানুষ যে সেখানে নেই এটা শতভাগ নিশ্চিত। তবে হারুন উর রশিদের পেজে ভিডিওটির মূল সূত্র কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। 

অন্যদিকে, ঢাকা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনে নাজমুল তারেকের পিছনে তার স্ত্রী ছিলেন এমন দাবিকে মিথ্যা বলা হয়। সেখানে বলা হয়,”সময়ের আলো জানায়, তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নাজমুলের বাসা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত প্রত্যেকটি সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করেন। এতে দেখা যায়, মোটরসাইকেলে নাজমুলের স্ত্রী ছিলেন না। এতে প্রমাণিত হয়, কনস্টেবল নাজমুল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়েছেন।”

একই দাবি করছে একাত্তর টিভিও। একটি ভিডিও প্রতিবেদন দেখুন এখানে

মোবাইল ফোনের অবস্থানের ভিত্তিতে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, ঘটনার সময় নাজমুলের স্ত্রীর অবস্থান ছিল বাসায়।

সুতরাং, পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে অভিযুক্ত নাজমুল তারকের বাইকের পিছনে তার স্ত্রী ছিলেন এমন কোনো তথ্য প্রমাণ ফুটেজে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং এই দাবির বিপরীতে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। যা বিশ্লেষণ করে বুঝা যায় ভাইরাল দাবিটি সঠিক নয়। তাই ফ্যাক্টওয়াচ বাইকের পিছনের আসনে অভিযুক্তর স্ত্রীর অবস্থানের দাবিটিকেমিথ্যাহিসেবে চিহ্নিত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

No Factcheck schema data available.