কিছু ফেসবুক পোস্টে মানুষকে ডান কাতে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, বাম কাত হয়ে ঘুমালে নাকি খাদ্যনালীতে পাকস্থলী থেকে প্রয়োজনীয় এসিড যেতে পারে না। ফলে খাবার হজম হয় না। কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, পাকস্থলীর এসিড খাদ্যনালীতে গেলে বরং পেটে জ্বালাপোড়া হয়। এরকম আরো কিছু যৌক্তিক কারণে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মানুষকে বাম কাত হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেন। ফলে, ডান কাতে ঘুমানোর পরামর্শ দেয়া পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” চিহ্নিত করছে।
বিভিন্ন কী-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের ওয়েবসাইট MedlinePlus এ গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) এর উপর লেখা একটি আর্টিকেল পাওয়া যায়। উক্ত আর্টিকেলে বলা হয় গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে পাকস্থলীর উপাদান পাকস্থলী থেকে খাদ্যনালীতে ঢুকে যায়। জিইআরডি খাদ্যনালীতে প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এরফলে পেটে জ্বালাপোড়া বা অন্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
যখন খাবার খাওয়া হয় তখন খাবারটি খাদ্যনালী দিয়ে গলা থেকে পাকস্থলীতে যায়। খাদ্যনালীর নিম্নাংশে অবস্থিত পেশী তন্তুগুলির একটি রিং গিলে ফেলা খাবারকে ফিরে যেতে বাধা দেয়। এই পেশী ফাইবারগুলিকে লোয়ার ইসোফেগাল স্ফিঙ্কটার (এলইএস) বলা হয়।
যখন পেশীর এই রিংটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয় না, তখন পাকস্থলীর উপাদানগুলো খাদ্যনালীতে ফিরে যেতে পারে না। একে রিফ্লাক্স বা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স বলে। তীব্র পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালীর আস্তরণেরও ক্ষতি করতে পারে।
Cleveland clinic এর ওয়েবসাইটেও গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) এর উপর লেখা একটি আর্টিকেল পাওয়া যায়। উক্ত আর্টিকেলেও বলা হচ্ছে জিইআরডি (গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে পাকস্থলীর এসিড উপাদানগুলো খাদ্যনালীতে চলে যায়। এরফলে বুকে জ্বালাপোড়া, খাদ্য বের হয়ে আসা, কাশি, বুকে ব্যথা, গিলতে সমস্যা, বমি, গলা ব্যথা এবং কর্কশতা হতে পারে। তবে জিইআরডি কোনো সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা এমন না। তবে দীর্ঘদিন ধরে জিইআরডি হলে ইসোফ্যাগিটিস, ব্যারেটস ইসোফ্যাগিটিস, ইসোফেগাল ক্যান্সার, খাদ্যনালীতে দাগ ইত্যাদি রোগ হতে পারে।
তবে খাবার হজমের জন্য পাকস্থলীর এসিড খাদ্যনালীতে যেতে হয় এমন কোন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি।
এই আলোচনা থেকে বলা যায় পাকস্থলীর এসিড খাদ্যনালীতে গেলে খাবার হজম হয় না বরং গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) হতে পারে। তাই খাবার হজমের জন্য খাদ্যনালীতে পাকস্থলীর এসিড যেতে হবে এই দাবী “মিথ্যা”।
ভাইরাল পোস্টগুলোতে আরো বলা হয় ডান কাত হয়ে ঘুমানো বিজ্ঞানসম্মত, প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মানব শরীরের জন্য উপকারী। উক্ত দাবীর সত্যতা অনুসন্ধানের জন্য “ The best side to sleep on for digestion” লিখে গুগল কি-ওয়ার্ড সার্চ করা হয়।
উক্ত অনুসন্ধানে verywellhealth এর একটি আর্টিকেল পাওয়া যায়। উক্ত আর্টিকেলে থেকে জানা যায় বাম কাত হয়ে ঘুমালে নিম্ন খাদ্যনালীর স্ফিঙ্কটার থেকে খাদ্য ও পাকস্থলির অ্যাসিড আলাদা হয় যার ফলে খাদ্যনালীতে পাকস্থলির এসিড যাবার সম্ভবনা কম থাকে। কারন খাদ্যনালীর ভিতর পাকস্থলীর এসিড ঢুকতে পারে না। বাম কাত হয়ে ঘুমালে পেটে জ্বালাপোড়া বা বদহজমের ঝুঁকি হ্রাস পেতে পারে।
উক্ত আর্টিকেল থেকে আরো জানা যায় গর্ভবতী মহিলাদের বুকে জ্বালাপোড়া একটি সাধারণ ঘটনা। গর্ভবতী মহিলাদের বাম কাত হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয় কারণ এটি রক্ত প্রবাহ এবং কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং জরায়ুর ক্রমবর্ধমান ওজন থেকে লিভারের চাপ কমিয়ে দেয়।
এছাড়াও বলা হয় কাত হয়ে ঘুমানোর কিছু উপকারিতা আছে। যাদের এসিড রিফ্লাক্স (পাকস্থলির এসিড যখন খাদ্যনালীতে চলে যায়) বা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজের কারণে বুকে জ্বালাপোড়া হয় তাদের বাম কাত হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
Healthline এর ওয়েবসাইটের আর্টিকেলেও একই রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে Healthline এর ওয়েবসাইট থেকে আরো জানা যাচ্ছে ২০১০ সালের একটা গবেষণায় দেখা গেছে ১০ জন অংশগ্রহণকারী ডান কাত হয়ে ঘুমালে বুকে জ্বালাপোড়া অনুভব করেছেন। কিন্তু তারা বাম কাত হয়ে ঘুমালে বুকে জ্বালাপোড়া অনুভব করেন নি। গবেষকরা মনে করেন বাম কাত হয়ে ঘুমালে পাকস্থলীর এসিড খাদ্যনালির নিচে অবস্থান করে। এজন্য বুকে জ্বালাপোড়া হবার সম্ভাবনা কম।
এছাড়া, হৃদপিন্ডের ভাল অবস্থানের জন্যও বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমানো ভাল এমন তথ্য এখানে পাওয়া যাচ্ছে। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং ওয়েব পোর্টালে ঘুমানোর সময় বাম কাতে ঘুমানোরই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন দেখুন – এনটিভি, রাইজিং বিডি, ইনকিলাব, বাংলানিউজ২৪ ডট কম ইত্যাদি সংবাদ মাধ্যমে ।
উক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় পরিপাক ক্রিয়ার জন্য ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমানোর থেকে বাম পাশে কাত হয়ে ঘুমানো উত্তম। মেডিকেল সায়েন্সেও এটাই বলা হয়। ভাইরাল পোস্টে ডান হয়ে ঘুমানোর যে উপকারিতার কথা বলা হয়েছে তা ভুল।
সারমর্ম
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয়, বাম কাত হয়ে ঘুমালে যে খাবার হজম হওয়ার জন্য খাদ্যনালীতে যে এসিড যেতে হয় তা বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু ফ্যাক্ট-চেকের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে খাবার হজমের জন্য খাদ্যনালীতে এসিড যাবার দরকার হয় না। তাছাড়া খাদ্যনালীতে এসিড গেলে পেটে বরং জ্বালাপোড়া হতে পারে। ভাইরাল পোস্টে আরো দাবি করা হয়, ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমানো খাবার হজমের জন্য উপকারী। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে ডান কাত হয়ে ঘুমালে বুকে জ্বালাপোড়া হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে কিন্তু বাম কাত হয়ে ঘুমালে পাকস্থলীর এসিড খাদ্যনালীতে ঢুকতে পারে না। এজন্য বুকে জ্বালাপোড়া হবার সম্ভাবনা কমে যায়। এজন্য মেডিকেল সায়েন্সে বাম কাত হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
যেহেতু ভাইরাল পোস্টে ডান কাত হয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে, এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?