প্রতি বছর ছয় মিলিয়ন মানুষ ইসলাম ত্যাগ করছে – দাবিটি বিভ্রান্তিকর

61
প্রতি বছর ছয় মিলিয়ন মানুষ ইসলাম ত্যাগ করছে – দাবিটি বিভ্রান্তিকর
প্রতি বছর ছয় মিলিয়ন মানুষ ইসলাম ত্যাগ করছে – দাবিটি বিভ্রান্তিকর

Published on: [post_published]

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে একটি পোস্ট শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, আল-জাজিরার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর ছয় মিলিয়ন মানুষ ইসলাম ত্যাগ করে। তবে, ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে উদ্ভূত দাবিটিতে যে ছয় মিলিয়ন মানুষের ইসলাম ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে, সেই “ছয় মিলিয়ন” সংখ্যাটি আল-জাজিরার নিজস্ব গবেষণায় প্রাপ্ত কোন পরিসংখ্যান নয়। বরং, ১২ ডিসেম্বর ২০০০ এ আল-জাজিরায় প্রকাশিত সাংবাদিক মাহির আব্দুল্লাহ (Maher Abdullah) কর্তৃক গৃহীত “Christianization in Africa” শিরোনামের একটি সাক্ষাৎকারে ধর্মপ্রচারক এবং লিবিয়ায় শরীয়া আইন নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শেখ আহমেদ আল-কাতানি (Sheikh Ahmed Al-Qatani) আফ্রিকায় খ্রিস্টীয়করণ (Christianization) সম্পর্কে বলেছিলেন, “আফ্রিকায় প্রতি ঘন্টায় ৬৬৭ জন মুসলিম খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন, প্রতিদিন ১৬ হাজার, এবং প্রতি বছর এই ধর্মান্তরিতের সংখ্যাটি ছয় মিলিয়ন।” উল্লেখ্য, শেখ আহমেদ আল-কাতানি তাঁর এই মন্তব্যের সমর্থনে কোন তথ্যসূত্র উল্লেখ করেননি। অতএব, ছয় মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছর ইসলাম ত্যাগ করে – এই তথ্যটি আল-জাজিরা দেয়নি। তাছাড়া, যে সাক্ষাৎকারে আল-কাতানি ছয় মিলিয়ন মানুষের ইসলাম ত্যাগের তথ্যটি দিয়েছেন সেটা প্রায় ২৩ বছরের পুরানো। স্বাভাবিকভাবেই, বর্তমানে উক্ত সংখ্যাটির কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।

এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে

Image: Example of a viral Facebook post

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত দাবিটির যথাযথতা যাচাই করতে প্রাসঙ্গিক কিছু কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে গুগল সার্চ করা হয় এবং উক্ত সার্চের ফলাফলে পয়েন্টার ইন্সটিটিউট এর ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রাম পলিটিফ্যাক্ট (Politifact) কর্তৃক প্রকাশিত Millions of Muslims converting to Christianity? Available data doesn’t support that claim – শীর্ষক শিরোনামের একটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। উক্ত প্রতিবেদন মারফত আল-জাজিরা টেলিভিশনের জন্য সাংবাদিক মাহির আব্দুল্লাহ কর্তৃক গৃহীত শেখ আব্দুল্লাহ আল-কাতানি এর সাক্ষাৎকারটির একটি আর্কাইভকৃত আরবি প্রতিলিপি বা ট্রান্সক্রিপ্ট (Transcript) খুঁজে পাওয়া গেছে। গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদকৃত ঐ ট্রান্সক্রিপ্টটি পড়ে দেখা গেছে যে, সাক্ষাৎকারের একটি অংশে শেখ আব্দুল্লাহ আল-কাতানি বলছেন, “In Africa there are now one and a half million churches, the number of members of these churches is 46 million, every hour 667 Muslims convert to Christianity, every day 16 thousand, every year 6 million, these huge, very large numbers.” অর্থাৎ, বাক্যটির বাংলা অনুবাদ করলে অর্থ এমন দাঁড়ায় যে, “আফ্রিকায় বর্তমানে ১৫ লাখ চার্চ রয়েছে এবং উক্ত চার্চগুলোর সদস্য সংখ্যা চার কোটি ৬০ লাখ, প্রতি ঘন্টায় ৬৬৭ জন মুসলিম খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন, প্রতিদিন ১৬ হাজার, এবং প্রতি বছর এই ধর্মান্তরিতের সংখ্যাটি ছয় মিলিয়ন, যা খুবই বিশাল একটি সংখ্যা।” তবে, আব্দুল্লাহ আল-কাতানি তাঁর এই মন্তব্যের সমর্থনে কোন তথ্যসূত্র ব্যবহার বা উল্লেখ করেননি। তাছাড়া, উক্ত সাক্ষাৎকারটি প্রায় ২৩ বছরের পুরানো হওয়ায় আল-কাতানি আফ্রিকায় প্রতি বছর মুসলিমদের ধর্মান্তরিত হওয়ার যে সংখ্যাটি উল্লেখ করেছিলেন বর্তমানে তার কোন প্রাসঙ্গিকতা আর থাকছে না।

Image: Transcription of the interview between Maher Abdullah and Ahmed Al-Qatani

 

কোন ধর্মের একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ যখন অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় তখন সেটা চিহ্নিতকরণ করা সম্ভব কিনা – এই সম্পর্কে গর্ডন-কনওয়েল থিওলজিকাল সেমিনারিতে কর্মরত জিনা জুর্লো (Gina Zurlo) পলিটিফ্যাক্টকে জানান যে, “পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গায় মানুষ তাদের ধর্মবিশ্বাস প্রকাশ্যে জানাতে নিরাপদবোধ করেন না, যার ফলে কোন বিশাল সংখ্যক ধর্মান্তরিতের ঘটনা ঘটে থাকলেও সেটা চিহ্নিতকরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।” তিনি আরও জানান যে, “একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীতে কতজন মানুষ আছেন তার পরিস্কার পরিসংখ্যান পাওয়া খুব দুরূহ কারণ তারা বিভিন্ন পন্থায় উক্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। যেমন: কেউ জন্মগতভাবেই একটি ধর্মের অধীনে চলে যায়, কেউ অভিবাসন বা অন্য একটি দেশে বসবাস করতে এসে কোন একটি ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়, বা কেউ অন্য একটি ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।” অতএব, জিনা জুর্লো এর শেষের মন্তব্যটি থেকে বুঝে নেওয়া যায় যে, কেবল ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে নয়, বরং আরও অন্যান্য কারণেও কেউ খ্রিস্টান ধর্মালম্বী হতে পারেন।

Image: Excerpt from Politifact’s fact-checking report

 

পিউ রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র ডেমোগ্রাফার এবং সহযোগী পরিচালক কনরাড হেকেট (Conrad Hackett) পলিটিফ্যাক্টকে জানিয়েছে যে, তিনি “এমন কোন তথ্য সম্পর্কে অবগত নয় যা দ্বারা মিলিয়ন মিলিয়ন মুসলিমদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার দাবিটির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।” তথ্যের এমন ঘাটতি থাকার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তিনি আরও জানিয়েছেন, “এটা অসম্ভব নয় যে ইসলাম ত্যাগের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন আইনি ঝামেলা এবং সামাজিক চাপের কারণে কিছু মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোতে মুসলিম থেকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন জরিপের অগোচরে থেকে যায়।” 

Image: Excerpt from Politifact’s fact-checking report

 

জিনা জুর্লো এবং কনরাড হেকেট, উভয়ের মন্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা এমন কোন তথ্য বা পরিসংখ্যান সম্পর্কে অবগত ন যার মাধ্যমে একটি বিশাল সংখ্যক ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। তাছাড়া, তাদের মন্তব্য থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, কেন এই ধরণের বিশাল সংখ্যক মানুষের ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনাগুলো বিভিন্ন জরিপ কিংবা পরিসংখ্যানের অগোচরে থেকে যায়। 

ইতিমধ্যে, পিউ রিসার্চ সেন্টার তাদের একটি গবেষণায় দেখিয়েছে যে, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসরত খ্রিস্টানদের তুলনায় লাতিন আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিস্টানদের মাঝে ধর্মীয় আনুগত্য সবচেয়ে বেশি। সাব-সাহারান আফ্রিকা বা আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত দেশগুলোতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে সেখানকার মানুষদের প্রজনন হার অনেক বেশি।

পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, ২০১৫ সালে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ ধর্মীয় গোষ্ঠী। অর্থাৎ, ঐ সময় খ্রিস্টানরা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ অধিকার করে রেখেছিলো। তবে, একই সময়ে ইউরোপে উক্ত ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিলো। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে মুসলিমরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ বা ১৮০ কোটি মানুষ নিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্থান অধিকার করে রেখেছিলো। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ঐ গবেষণা প্রতিবেদনটিতে অনুমান করা হয়েছিলো যে, ২০৬০ সাল নাগাদ মুসলিমরা প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হবে। তাছাড়া, পিউ রিসার্চ সেন্টারের আরেকটি প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছিলো যে, ২০৩৫ সাল নাগাদ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।

Image: Excerpt from the Pew Research Center’s report

 

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সামাজিক মাধ্যমে উত্থাপিত প্রতি বছর ছয় মিলিয়ন মানুষ ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছে – এই দাবিটিকে সমর্থন করে এমন কোন নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ নেই। তাছাড়া, আল-জাজিরাকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে যে দাবিটি করা হচ্ছে সেটা আল-জাজিরা টেলিভিশনকে দেওয়া আব্দুল্লাহ আল-কাতানি এর একটি সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এটি আল-জাজিরা টেলিভিশনের নিজস্ব গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য নয়।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh