সম্প্রতি ফেসবুকে বেশ কিছু পোস্টে ‘এলিজা কার্সন’ নামে একটি মেয়ের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, এবং বলা হচ্ছে ১৭ বছর বয়সী মেয়েটি ২০৩৩ সালে মঙ্গল গ্রহে গিয়ে আর ফিরে আসবে না। বাস্তবে এটি একটি ভূয়া তথ্য যা গতবছর বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। নাসা এখন পর্যন্ত অ্যালিজা কে মঙ্গলগ্রহের কোনো মিশনে অন্তর্ভুক্ত করে নি। ফলে উক্ত পোস্টগুলোতে উল্লেখিত ২০৩৩ সালে তার মঙ্গলে যাওয়ার তথ্যটি মিথ্যা।
বাংলাদেশের কিছু সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মার্কিন তরুণী অ্যালিজা কার্সনকে বিভিন্ন রকম অতিরঞ্জিত এবং অসত্য দাবি সম্বলিত পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আমাদের চোখে পড়েছে।
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে ‘এলিজা কার্সন, মঙ্গলের বুকে হারিয়ে যাবে যে মেয়ে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করেছিল করেছিল somoynews.tv যেখানে তাকে “নাসার কনিষ্ঠতম সদস্য” হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে:
“অফিসিয়ালি নাসা ১৮ বছরের আগে কাউকে নভোচারী হিসেবে আবেদন করার সুযোগ দেয় না। তবে এলিজার ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি। … যেহেতু সে মঙ্গলে গেলে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম তাই নাসার কাছে সে কোনো প্রকার যৌনতা, বিয়ে বা সন্তানধারণের নিষেধাজ্ঞাপত্রতে সাক্ষর করেছে।”
বাংলাদেশ প্রতিদিনও শেষ তিন লাইন বাদে হুবহু একই রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানেও বলা হয় “এই মেয়েটি হবে ২০৩৩ সালে মঙ্গলে যাওয়া পৃথিবীর প্রথম মানুষ।” দু’টি রিপোর্টেই আবেগঘন ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে,
“এলিজা কার্সন আমাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়। সে বলে- ‘Always Follow Your Dream and Don’t let Anyone Take it From You.”
ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায়, অ্যালিজা এই কথা আসলেই বলেছেন, তবে তা নাসার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য বা মঙ্গলগামী প্রথম মানুষ হিসেবে নয়। হিউস্টন এসোসিয়েশন ফর স্পেইস এন্ড সায়েন্স এডুকেশন নাম একটি সংগঠনের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ২০২০ সালের ১৮ই জানুয়ারী তিনি এই বক্তব্য রাখেন। মহাকাশচারী হবার জন্য অ্যালিজা কার্সন তার অধ্যবসায় এবং স্বপ্নের কথা বলেন সেখানে। অ্যালিজা নাসার সদস্য কিংবা মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছেন সেরকম কোন তথ্য সেখানে নেই।
অ্যালিজার নিজস্ব ওয়েবসাইটে এমন কোনো তথ্য উল্লেখ নেই যে তিনি কোনো মঙ্গল অভিযানের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি বর্তমানে ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এস্ট্রো-বায়োলজি পড়ছেন।অ্যালিজা বেশ অনেক বছর ধরেই সংবাদ মাধ্যমে সাড়া জাগিয়ে চলেছেন সঙ্গত কারণেই। বারো বছর বয়সে অ্যালিজা যখন দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেন, ততদিনে নাসার তিনটি পৃথক স্পেস ক্যাম্পে অংশ নেওয়া হয়ে গিয়েছিল তার। পরবর্তীতে তিনি কেনেডি স্পেস সেন্টার ভিজিটর কমপ্লেক্সের ‘‘পাসপোর্ট টু এক্সপ্লোর স্পেস’ প্রোগ্রামটি সম্পন্ন করেন।
তিনি ২০১৬ সালের অক্টোবরে এডভ্যান্সড পসাম একাডেমি থেকে মহাকাশ যাত্রার জন্য ছাড়পত্র পান যা তাকে শিক্ষানবিশ মহাকাশচারী হবার যোগ্যতা দেয়। মঙ্গল প্রসঙ্গে সেখানে বলা আছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নাসা তাকে ওয়াশিংটন ডিসিতে Mars Exploration Rover 10 প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করে। প্যানেলের সদস্য হিসেবে তিনি নাসা টিভিতে মঙ্গলগ্রহে ভবিষ্যত মিশন বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন। এই তথ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় নাসার ওয়েবসাইটে।
নিয়ম ভঙ্গ করে তাকে নিয়োগ করা হয়েছে এই দাবির বিপরীতে সরাসরি নাসার দেওয়া তথ্যই বিবেচ্য: নাসার অ্যাস্ট্রোনট ক্যান্ডিডেট প্রোগ্রামের আবেদনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়স সীমা নেই। এখন পর্যন্ত নির্বাচিত নভোচারী প্রার্থীদের বয়স ছিল ২৬ থেকে ৪৬ বছর বয়সের মধ্যে (গড় বয়স ৩৪ বছর)।
এই ভুয়া দাবিগুলি অত্যন্ত মনোগ্রাহী হওয়াতে ফেইসবুকে জনপ্রিয় হয়। অনেক কেই দেখা যায় অ্যালিজাকে নিয়ে পোস্ট দিতে। ২০২০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি রোর বাংলার প্রতিবেদনেও বোরড পান্ডার বরাত দিয়ে দাবি করা হয়েছে, “এলিসা মঙ্গলগ্রহ বা রেড প্ল্যানেটে পাড়ি জমাবে ২০৩০ সালে, ২৯ বছর বয়সে। এর পূর্বে সে প্রেম বা বৈবাহিক কোনো ধরনের সম্পর্কে জড়ানো অথবা সন্তান জন্ম দিতে অনুমতি পাবে না।” অথচ উৎসে গিয়ে দেখা যাচ্ছে এই বিষয়ে অ্যালিজার সংকল্পের কথা বলা হয়েছে মাত্র।
অ্যালিজা কার্সন যেহেতু এখনও নাসায় ডাক পান নি, তার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হবার কোন সুযোগ নেই। তাকে মঙ্গল গ্রহের কোনো মিশনে অন্তর্ভুক্ত করে নি নাসা আর করলেও সেক্ষেত্রে কোন নিয়ম ভঙ্গ হত না। যেহেতু তিনি নাসার সাথে তার কোন চুক্তি হয় নি, অতএব তার বিয়ে করতে না পারা বা সন্তানধারণের নিষেধাজ্ঞাপত্রতে সাক্ষর করতে হওয়া অপ্রাসঙ্গিক এবং অসত্য।
প্রতিবেদনের ভিন্নদিকে মোড় নেওয়া
অ্যালিজাকে নিয়ে অতিরঞ্জিত খবরের জনপ্রিয়তাকে আরেকবার ব্যবহার করে ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে সময় টিভি “পৃথিবীতে আর ফিরবেন না, মঙ্গলের বুকে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখছেন এলিসা!” শিরোনামে আরও একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে তারা দুই বছর আগের প্রতিবেদনে উল্লেখিত মিথ্যা তথ্যই আবারও ব্যবহার করে।
ঠিক সাত দিন পরেই তারা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার শিরোনাম: “মঙ্গলে যাচ্ছেন না এলিজা”। সেখানে তারা তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান বুম বাংলাদেশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লেখে, “মিডিয়ায় ১৭ বছর বয়সী অ্যালিজা কার্সন নামে এক তরুণীর ছবি শেয়ার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।” তারা বুম বাংলাদেশের প্রতিবেদনটি প্রায় হুবহু তুলে দিয়ে লেখে: “এলিজা কার্সনকে নাসা প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের প্রথম মানববাহী মঙ্গল অভিযানের জন্য নির্বাচিত করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এই দাবিটি ভুয়া।”
এই বিভ্রান্তি ছড়ানোতে নিজেদের ভূমিকার কথা এড়িয়ে গিয়ে সময় নিউজ আরেকবার বিভ্রান্তি তৈরী করেছে “এলিসা মঙ্গলে যাচ্ছেন না” শিরোনাম দিয়ে। তাদের এই প্রতিবেদনে এমন কোন তথ্য নেই যার ভিত্তিতে বলা যায় অ্যালিজা মঙ্গলে যাচ্ছেন না কারণ মঙ্গল মিশনে যাবার জন্য তাকে প্রত্যাখ্যান করা হয় নি বা তিনি তার মহাকাশ যাত্রার সংকল্প পরিত্যাগ করেন নি। তিনি মহাকাশচারী হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে মঙ্গলে যাবেন কি যাবেন না এমন বলার সময় এখনও আসে নি।
দেশে বিদেশে এই সম্ভাবনাময় তরুণ মহাকাশপ্রেমীকে নিয়ে মানুষের কৌতুহলের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রকম ভুয়া খবর তৈরি হচ্ছে। পূর্বোল্লেখিত আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা স্নোপস ছাড়াও পলিটিফ্যাক্ট আগেও অ্যালিজাকে নিয়ে ছড়ানো বিভিন্ন খবরকে ভুল প্রমাণ করেছে।
দেশে বিদেশে এই সম্ভাবনাময় তরুণ মহাকাশপ্রেমীকে নিয়ে মানুষের কৌতুহলের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রকম ভুয়া খবর তৈরি হচ্ছে। পূর্বোল্লেখিত আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা স্নোপস ছাড়াও পলিটিফ্যাক্ট আগেও অ্যালিজাকে নিয়ে ছড়ানো বিভিন্ন খবরকে ভুল প্রমাণ করেছে।