হিন্দু ধর্মাবলম্বী মৃত্যুপথযাত্রীর কানে কানে পুরোহিত বিশেষ “আনকাহি” মন্ত্র উচ্চারণ করেন -এমন একটি দাবি দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকে এবং ইউটিউবে প্রচারিত হচ্ছে। এই আনকাহি মন্ত্রে আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মেনে নেয়ার কথা বলা হয়েছে, যা সনাতন ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এমন মন্ত্রোচ্চারণের দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
গুজবের উৎস
এমন দাবি সম্পর্কিত কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে। এদের মধ্যে এই একটি ভিডিওই ৪৬ লাখ মানুষ দেখেছেন। আরেকটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কমপক্ষে ২৬৯ জন ফেসবুক ব্যবহারকারী এই ভিডিওটি False Information ক্যাটাগরিতে রিপোর্ট করেছেন।
ইউটিউবেও একই দাবি সম্বলিত পোস্ট দেখা যায় । এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে । ইউটিউবের ভিডিও দেখে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে এই গুজব প্রচলিত রয়েছে।
ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান
২ মিনিট ৪২ সেকেন্ডের মূল ভাইরাল ভিডিওতে বলা হয়েছে,
মুসলমানরা মৃতদেহকে গোসল করিমে সাদা কাপড় ও মাথার পাশে বসে কোরান তেলাওয়াত করে কবর দেয়। আর হিন্দুরা মৃতদেহকে গোসল করিয়ে সাদা কাপড় রাখে তারপর তাদের পুরোহিতরা এসে মৃতদেহের কানে বারবার একটি মন্ত্র পাঠ করতে থাকে, তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরোহিতরা যে মন্ত্রটি পাঠ করে সেটা অন্য কাউকে জানতে দেয় না সেটি সকল হিন্দুদের কাছে গোপন করা হয়েছে এই মন্ত্রটি যদি হিন্দুরা জেনে যায় তাহলে হিন্দুরা আর হিন্দু ধর্ম পালন করবে না, এবার ভারতের এক হিন্দু পুরোহিত এই মন্ত্রটির রহস্য ফাঁস করলেন তিনি বলেন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বেদে একটি মন্ত্র আছে তার। নাম আনকাহি মন্ত্র যেটি পুরোহিতরা সকল হিন্দুদের কাছে গোপন করে রাখে, এই মন্ত্রটি সংস্কৃত ভাষায় আছে যার অর্থ হল এই ভক্ত লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়লে তোমার পাপ মোচন হয়ে যাবে আর আল্লাকে তোমার সৃষ্টিকর্তা মেনে নিলে তোমার পরিত্রাণহয়ে যাবে আর চিরজীবনের জন্য তুমি স্বর্গ লাভ করবে তাই মুহাম্মদ নাম বার বার জপ ।
আর সংস্কৃত ভাষায়এই মন্ত্রটি হল, লা ইলাহা হরতি পাপম্ ইল ইলাহা পরম পাদম
জন্ম বৈকুণ্ঠ অপ্ ইনুতি ত জপি নাম মুহাম্মদ
লক্ষণীয়, ভিডিওতে উক্ত ব্যক্তি হিন্দি ভাষায় আনকাহি মন্ত্রের বর্নণা দিলেও তিনি মুমূর্ষু রোগীর কানে কানে এই মন্ত্র শোনানোর ব্যাপারে কিছু বলেন নি।
এছাড়া , তাকে পুরোহিত হিসেবে অভিহিত করা হলেও তার পুরোহিতের পরিচয়জ্ঞাপক কোনো পোষাক আশাক দেখা যায়নি। কাজেই তিনি কোনো হিন্দু পুরোহিত নাকি কোনো সাধারণ গ্রামবাসী, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ভিডিওতে উক্ত আনকাহি মন্ত্রের মূল উৎস বলা না হলেও দৈনিক ইনকিলাব এর এই নিবন্ধে এবং ফেসবুকের এই পোস্টে উক্ত শ্লোককে উত্তরণ বেদ এর “আনকাহি-পঞ্চম অধ্যায়” এর অংশ বলে দাবি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ , সামবেদ এবং অথর্ববেদ ছাড়া উত্তরণ বেদ কিংবা অন্য কোনো বেদের অস্তিত্ত্ব পাওয়া গেল না।
Sanatan Vedic Dharma ইউটিউব চ্যানেলের এই এবং এই ভিডিও থেকে জানা যাচ্ছে, প্রতিটা মন্ত্রের স্তুতি, প্রার্থনা এবং উপাসনা অংশ থাকে। প্রতিটা মন্ত্রের মধ্যে মন্ত্রদ্রষ্টা হৃষি ,অর্থদ্রষ্টা হৃষি এবং নির্দিষ্ট দেবতার উল্লেখ থাকে। এ সকল নিয়ম কানুন অনুসরণ না করেই আলোচ্য আনকাহি মন্ত্রটি রচিত হয়েছে।
মৃত্যুপথযাত্রী সনাতন ধর্মাবলম্বীকে গীতাপাঠ করিয়ে শোনানো , গঙ্গাজল পান এবং তুলসী পাতার উপস্থিতির কথা জানা যায় ।
এছাড়া মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠের কথাও অনেকে বলেন।
সনাতন ধর্মাবলম্বী কারো মৃত্যু সংবাদ শুনলে অন্যরা ‘দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু‘ মন্ত্রটি উচ্চারণ করেন।
তবে আনকাহি মন্ত্র ব্যবহারের উল্লেখ কোনো প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যায়নি। বরং ‘আনকাহি মন্ত্র ব্যবহারের গুজব’ এর বিরুদ্ধে অনেকে বিভিন্ন সময়ে পোস্ট করেছেন। যেমন দেখুন এখানে , এখানে , এখানে।
উত্তরণ বেদ ছাড়া আর কোথাও কি আনকাহি মন্ত্র রয়েছে ?
আনকাহি মন্ত্রের উৎস হিসেবে উত্তরণ বেদ/ উত্তরায়ণ বেদ ছাড়া অন্য কোনো উৎসের কথা ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে ধরা পড়েনি। তবে একই ধরনের আরবি-ফারসি শব্দযুক্ত প্রচুর শ্লোক দেখা যায় আল্লোপনিষদে।
উপনিষদ কে বেদের ব্যাখ্যা/বেদের বিষয়বস্তু/বেদান্ত হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রতিটি উপনিষদই কোনো না কোনো বেদ এর সাথে সম্পর্কিত। দুশোটিরও বেশি উপনিষদের কথা জানা যায়। তবে এদের মধ্যে ১০৮ টি উপনিষদ হল প্রামাণ্য । বাকি উপনিষদগুলির গ্রহণযোগ্যতা কম। তেমনই একটি উপনিষদ হল আল্লোপনিষদ।
ধর্মতত্ত্ববিদ আর. অনন্তকৃষ্ণ শাস্ত্রী লিখেছেন ভারতে মুসলমানদের শাসনামলে “আর্য পণ্ডিতরা শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে” এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন যে, এই গ্রন্থটি “সাধারণ উপনিষদ্গুলির রচনাভঙ্গি অনুসরণ করে লেখা হয়নি” এবং এই গ্রন্থে ব্যবহৃত শব্দগুলি “শুনতে অনেকটা আরবির মতো।‘’
স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন যে, আল্লোপনিষদ্ যে অনেক পরবর্তীকালের রচনা তার প্রমাণ রয়েছে। তিনি শুনেছিলেন আকবরের রাজত্বকালে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই উপনিষদ্টি রচিত হয়েছিল।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আকবরের রাজত্বকালে হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থটি রচিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে, আল্লোপনিষদ্ ছিল “ভারতের মুসলমান শাসকদের কিছু তোষামোদকারীর নির্লজ্জ রচনা।
কাজেই, আল্লোপনিষদে যদি কোনো আরবি শব্দযুক্ত মন্ত্র বা শ্লোক পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ঐশী শ্লোক হিসেবে বিশ্বাসী হিন্দুরা গ্রহণ করেন না। অন্যদিকে বেদ কিংবা প্রধান উপনিষদগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এগুলো লেখা হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৮০০ অব্দ এর কাছাকাছি সময়ে। সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীরা বেদকে “অপৌরুষেয়” (“পুরুষ বা লোক” দ্বারা কৃত নয়, অলৌকিক) এবং “নৈর্বক্তিক ও রচয়িতা-শূন্য” (যা সাকার নির্গুণ ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় এবং যার কোনও রচয়িতা নেই) বলে বিশ্বাস করেন।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
মুমূর্ষু সনাতন ধর্মাবলম্বীর কানে আরবি শব্দযুক্ত আনকাহি মন্ত্র শোনানোর দাবির পক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। একই সাথে, কথিত আনকাহি মন্ত্রের উৎস কিংবা এর সাথে ইসলাম ধর্মের সম্পর্ক খুজে পাওয়া যায়নি।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?