টিকা-বিরোধীদের কথা
Published on: [August 3,2021]
Jahirul Islam
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠন আছে, যারা ভ্যাক্সিন বা টিকাকে মানব শরীরের জন্য বিপজ্জনক মনে করে। এ কারণে তারা নিজেরা টিকা নেয় না, এবং অন্যকেও টিকা নিতে নিরুৎসাহিত করে। এ বিষয়ে একেকটা সংগঠনের যুক্তি একেক রকম। কেউ শুধু নির্দিষ্ট কোনো টিকার বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার কেউ সব ধরনের টিকার বিরুদ্ধেই কথা বলে। এদেরকে সংক্ষেপে ইংরেজিতে anti-vaccination organization বা anti-vaxxers নামে চিহ্নিত করা হয়। বাংলায় এদের আমরা টিকা-বিরোধী বলতে পারি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO-এর মতে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলমান টিকাদান কর্মসূচির কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবন বেঁচে যাচ্ছে। তবে একই সাথে, ১৫ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে কেবলমাত্র এই টিকা না নেওয়ার কারণে। এই ১৫ লাখ মানুষকে খুব সহজেই টিকা দিয়ে বাঁচানো যেত।
১। ডাক্তার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিছু স্বনামধন্য ডাক্তার কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সময়ে টিকার বিরোধিতা করতে দেখা গিয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ইংল্যান্ডের ডাক্তার Andrew Jeremy Wakefield । লেখাপড়া করেছিলেন ইংল্যান্ডে এবং কানাডায়। ১৯৯৮ সালে তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিখ্যাত Lancet ম্যাগাজিনে । পেপারটায় তিনি দেখান , measles, mumps, and rubella (MMR) vaccine নিলে বাচ্চাদের অটিজম হচ্ছে।
অটিজম হলো মস্তিষ্কের বিকাশজনিক সমস্যা । অটিস্টিক শিশুদের বুদ্ধি-বৃত্তিক বিকাশ অন্য শিশুদের মতো হয় না। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিন্তাভাবনা এবং কর্মপদ্ধতি সাধারণ শিশুদের থেকে আলাদা হয়।
ল্যানসেট ম্যাগাজিন খুবই নির্ভরযোগ্য একটি পিয়ার রিভিউড জার্নাল। তাই এই জার্নালের কথা অনেকেই মেনে নিলেন। অনেক বাবা মা-তাদের সন্তানদেরকে এই টিকা দিলেন না। বাংলাদেশে শিশুদের জন্মের পর পরই কিছুদিনের মধ্যে ৬ টি রোগের টীকা একসাথে দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় শিশুদের হাম, মাম্পস আর রুবেলা রোগের টীকা একসাথে দেওয়া হয়।
যাই হোক, ওয়েকফিল্ডের গবেষনা প্রকাশ হওয়ার পরে, সে বছর ইংল্যান্ডে মাত্র ২০% বাচ্চাকে তাদের বাবা মা টীকা দিয়েছিল, অটিস্টিক হওয়ার ভয়ে । তবে , রেজাল্ট হিসেবে পরবর্তী কয়েক বছরে ইংল্যান্ডের বাচ্চাদের প্রচুর হাম, রুবেলা এবং মাম্পস হতে লাগল। এই অসুখগুলো খুব সহজেই ভ্যাক্সিন দিয়ে বন্ধ করা যেত।
ওয়েকফিল্ডের পেপারটা সহজে সবাই মেনে নেন নি। অন্যান্য ডাক্তাররা গবেষণা করে দেখলেন , অটিজম রোগের কারণটা জেনেটিক। কোনো ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণের কারণে এই রোগ হয় না। জন্মগতভাবেই এটা হয়। সুতরাং ৯ মাস বয়সে কোনো টিকার কারণে একজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে না।
সুতরাং , ল্যানসেটে প্রকাশিত হলেও ওয়েকফিল্ডের ওই গবেষণা নিতান্তই ভুল ছিল। একের পর এক অন্যান্য পরবর্তী বিভিন্ন গবেষণায় সেটাই প্রমাণিত হল।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, ওয়েকফিল্ডের ওই পেপারে মাত্র ১২ টি শিশুর উপর গবেষণা চালানো হয়েছিল এবং এদের অনেকেরই অটিজম ছিল না। ওয়েকফিল্ড গবেষণার প্রকৃত তথ্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছামত ডাটা সাজিয়ে জার্নালে পাঠিয়েছিলেন।
সব কিছু প্রমাণ হয়ে যাওয়ার পরে ল্যানসেট ম্যাগাজিন তাদের জার্নাল থেকে ওয়েকফিল্ড এর পেপারটা সরিয়ে দেয় । ডাক্তার ওয়েকফিল্ড কে মেডিকেল প্রাকটিস থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। তার অর্জিত সকল সম্মান ,পদক ফেরত নেওয়া হল। জালিয়াতির মামলাও হল তার বিরুদ্ধে।
তবে ওয়েকফিল্ড এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, আমার গবেষণায় আমি যা পেয়েছি, সেটাই লিখেছি। কোনো দুর্নীতি করিনি।
২০১৬ সালে তিনি Vaxxed: From Cover-Up to Catastrophe নামে একটি সিনেমাও পরিচালনা করেছেন । ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে তার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ।
সাম্প্রতিক সময়ে , ফাইজার-এর সাবেক চিকিৎসাবিজ্ঞানী , ডক্টর মাইকেল ইডন ( Michael Yeadon) করোনার টিকার বিরোধীতা করছেন। ৬০ বছর বয়সী ফাইজার এর এই সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এলার্জি এবং শ্বাসতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। ২০২১ এর এপ্রিল মাসে তিনি বলছেন, করোনার টিকা নিলে মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে এবং যারা যারা এই টিকা নেবে, তারা দুই বছরের মধ্যে মারা যাবে!
তার এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন দিকে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
কেনিয়াতে ডাক্তার স্টিফেন কারানজা নামের এক গাইনোকোলজিস্ট ছিলেন, যিনি কোভিড সহ অন্যান্য টিকার বিরোধিতা করতেন। গত এপ্রিল মাসে তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ইটালির ডাক্তারদের একটি সংগঠন ১০ জন ডাক্তারকে টিকাবিরোধী প্রচারণা ছড়ানোর দায়ে শাস্তি দিয়েছেন ।
বাংলাদেশে ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির একটি ভিডিওতে দাবী করেছেন, ভ্যাকসিন দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি ছাড়া খাদ্যাভ্যাস বদলে কোভিড-১৯ এর মতো রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সমালোচনার মুখে তিনি এই ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছেন। ডাক্তারদের একটি সংগঠন, Foundation For Doctors’ Safety, Rights and Responsibilities তার বিরুদ্ধে মামলা করার আল্টিমেটাম দিয়েছে।
২। বিভিন্ন দেশের সেলিব্রেটিগণ
অভিনেতা,গায়ক, খেলোয়াড় বা অন্যান্য বিভিন্ন পেশার কিছু সেলিব্রেটি ব্যক্তিত্ব টিকার বিরোধিতা করে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। যেমন ধরুন- আমেরিকার অভিনেত্রী জেনি ম্যাককার্থি। তিনি একাধারে অভিনেত্রী, মডেল, টিভি উপস্থাপক, রেসলিং খেলোয়াড়।
২০০২ সালে তার সন্তান ইভান্স এর জন্ম হয় । বাচ্চাটা একটু অস্বাভাবিক ছিল। ২০০৫ সালে ডাক্তাররা নিশ্চিত হয়, বাচ্চাটা অটিস্টিক। ২০০৭ সালে জেনি ম্যাককার্থি বলা শুরু করেন, আমার বাচ্চার অটিজম এর পিছনে ভ্যাক্সিন দায়ী। ছোটবেলায় , ৯ মাস বয়সে আমি ওকে MMR এর টিকা দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম । ওই টিকা নেয়ার কারণেই আমার বাচ্চাটা অটিস্টিক হয়ে গেছে।
২০০৭ সালে তিনি ভ্যাক্সিন এবং অটিজম এর সম্পর্ক এবং তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে Louder than Words: A Mother’s Journey in Healing Autism বইটা লেখেন। বইটা বেশ পপুলার হয়। তার অনেক ভক্ত -সমর্থক জুটে যায়। প্রচুর টিভি টক শো তে ডাক পেতে থাকেন তিনি। সবজায়গাতেই তিনি টিকা-বিরোধী প্রচারণা চালান। সব টক শোতে গিয়েই তিনি বলেন, তোমরা বাচ্চাদের টিকা দিয়ো না। এটা তোমার বাচ্চাদের অটিস্টিক বানিয়ে ফেলবে। আমার বাচ্চার ক্ষেত্রে যা হয়েছে , তোমাদের বাচ্চার ক্ষেত্রে সেটা করো না।
Generation Rescue নামে একটি এনজিও খুলে ফেললেন তিনি। এই এনজিও প্রচার করে — টিকার কারণে অটিজম হয়। তার নামডাক আরো ছড়িয়ে পড়তে লাগল । তাকে আমেরিকার most prominent purveyor of anti-vaxxer ideology” এবং “the face of the anti-vaxx movement” বলে প্রচার করা হতে লাগল।
আমেরিকার বিখ্যাত ডিকাংকার জেমস রান্ডির ফাউন্ডেশন প্রতিবছর সেরা ধান্দাবাজ/প্রতারকদের Pigasus Award দেয় । ২০০৮ সালে এই পুরষ্কার পান জেনি ম্যাককার্থি । কারণ, জেমস রান্ডির ভাষায়, “She Fooled the Greatest Number of People with the Least Amount of Effort” (রেফারেন্স?)
জেন ম্যাককার্থি একা নয়, আরো অনেক সেলিব্রেটি এইরকম টিকা-বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এদের মধ্যে আছে অভিনেত্রী Kristin Cavallari, গায়িকা টনি ব্রাক্সটন, অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো, অভিনেতা জিম ক্যারি এবং প্রেসিডেন্ট জন্ এফ কেনেডির ভাতিজা রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র।
৩। টিকা-বিরোধী সংগঠনসমূহ
ফেসবুকে Stop Mandatory Vaccination এই নামে একটা সিক্রেট গ্রুপ ছিল। গ্রুপের মেম্বর ছিল ৩৬০ হাজার । গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন Larry Cook নামের এক লোক। তার কোন মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তিনি ছিলেন সাউন্ড টেকনিশিয়ান। তবে Naturopath নামের একটা অল্টারনেটিভ মেডিসিনের চর্চা করেন। হোমিওপ্যাথির মতই একটা মেডিসিন সিস্টেম হচ্ছে এই ন্যাচারোপ্যাথ, যেটাকে মুলধারার ডাক্তাররা বলেন ভুয়া। উইকিপিডিয়ায় একে সিউডোসায়েন্স (অপবিজ্ঞান) বলা হয়েছে।
কোনো বাচ্চা যে কোনো রোগে ভুগেই মারা যাক না কেন, ল্যারি কুক দাবি করেন, টিকা নেয়ার কারণে এই বাচ্চা মারা গেছে। সেই বাচ্চাদের শোকসন্তপ্ত বাবা মায়েদেরকে নিজের গ্রুপে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন তিনি , এবং তাদের কাছে ন্যাচারোপ্যাথের ওষুধ বিক্রি করার ধান্ধা করেন।
ফেসবুকে টিকা-বিরোধী প্রচারণার অনেক বিজ্ঞাপনও দেন তিনি। ফেসবুক অবশ্য করোনার পরে এই বিষয়ে নীতিমালা কঠোর করেছে।
COVID-19 সম্পর্কে ল্যারি কুক বলেছে, জনগন যেন করোনার ভয়ে টিকা নেয়, সেজন্য সরকার করোনা মহামারির গুজব ছড়িয়েছে। আসলে এগুলা কিছুই না।
তার মতে, ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল কেবল টিকা নেয়ার কারণেই। এবারও করোনার টিকা দেয়া হলে করোনা বা অন্যান্য রোগ বালাই আরো বেশি করে ছড়াবে ।
ফেসবুক গত নভেম্বর, ২০২০ এ তার ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপ বন্ধ করে দিয়েছে।
ল্যারি কুকের স্টপ ম্যান্ডেটরি ভ্যাক্সিনেশন ছাড়াও আরো অনেক সংগঠন টিকার বিরোধিতা করে মিটিং-মিছিল-সেমিনার করছে প্রতিনিয়ত । যেমন- রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র এর Children’s Health Defense, ক্যালিফোর্নিয়ার তিন নারীর বানানো Freedom Angels Foundation, ডেল বিগট্রি এর Informed Consent Action Network, ব্রান্ডি ভন এর Learn the Risk, কানাডার Vaccine Choice Canada ইত্যাদি সংগঠন উল্লেখযোগ্য ।
উইকিপিডিয়ায় এমন কমপক্ষে ৩০ টা টিকা-বিরোধী সংগঠনের লিস্ট পাওয়া গেল।
৪। অল্টারনেটিভ মেডিসিন গ্রুপগুলো
হোমিওপ্যাথি, ন্যাচারোপ্যাথি, চিরোপ্রাকটিস এবং এই ধরনের অলটারনেটিভ মেডিসিন গ্রুপগুলোতে টিকা বলে কোনো কিছু নেই। এমনকি এদের চিকিৎসাবিদ্যায় ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার কথাও নেই। রোগ হওয়ার পরেই রোগের চিকিৎসা করে এরা । অন্যদিকে টিকার কাজ রোগ হওয়ার আগেই রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরে এন্টিবডি তৈরি করে দেয়া।
অস্ট্রেলিয়ায় ‘হোমিওপ্যাথি প্লাস’ নামে একটা সংগঠন আছে, যারা দাবি করে, টিকার বিকল্প হিসেবে তাদের হোমিওপ্যাথি ওষুধগুলো কার্যকর।
কিছু কিছু অলটারনেটিভ মেডিসিন সিস্টেম বর্তমানে এমন কিছু মেডিসিন বিক্রি করছে, যেগুলা , (তাদের ভাষায়) টিকার বিষ শরীর থেকে বের করে দেয় । যেমন- Chelation therapy বা হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপি । যারা অতীতে ছোটবেলায় বিভিন্ন রোগের টিকা নিয়েছে, তাদের কাছে এই সব ওষুধ বিক্রি করার চেষ্টা করে তারা।
৫। কন্সপাইরেসি থিওরিস্ট গ্রুপগুলো
আমেরিকান কিংবা ইউরোপিয়ানদের একাংশ বিশ্বাস করেন যে করোনা ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে চীনের উহানের একটি ল্যাবে। এরপরে এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, বিশ্বের প্রতিটা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়ে চীন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন ধরনের কনস্পাইরেসি থিওরি দেখা যায়। তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মুসলিম ধর্মাবলম্বী বিশ্বাস করেন, ইজরাইল থেকে এই ভাইরাস ছড়ানো হয়েছে মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাস করার জন্য।
২০১৮ সালে ভারতে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে, MR-VAC ভ্যক্সিন ( হাম এবং রুবেলা) এর মধ্যে বিশেষ কিছু রাসায়নিক মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলিমদের শরীরে এই ভ্যাক্সিন দেওয়া হলে মুসলিমরা বন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাদের আর বাচ্চা-কাচ্চা হবে না। ফলে দেশটাতে মুসলিম জনসংখ্যা কমবে। নরেন্দ্র মোদি এইভাবে দেশে মুসলমানদের জনসংখ্যা কমাতে চায় ।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এটাকে ফেক নিউজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তবে অনেক মুসলিম তখন টিকা নেয়া থেকে বিরত ছিলেন। টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে উত্তর প্রদেশে অনেকগুলি মাদ্রাসা ব্যবহৃত হয়েছিল , সেই মাদ্রাসাগুলোতে কেউই টিকা নিতে আসেনি ।
ফাইভ-জি মোবাইল তরঙ্গের সাথেও অনেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের যোগসূত্র দেখতে পান। তাদের দাবি, ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের কারণে এই নতুন রোগ এসেছে। এটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য করোনাভাইরাস এর কথা বলা হচ্ছে।
৬। রাজনৈতিক নেতারা
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বাস করতেন যে , MMR ভ্যাক্সিনের ফলে অটিজম তৈরি হয়। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের আগে একটা লাইভ টিভি বিতর্কে তিনি বলেছিলেন, আমার পরিচিত ২ বছরের একটা বাচ্চা আছে, টিকার কারণে সে এখন অটিস্টিক ।
আমেরিকায় যে গ্রুপগুলো ভ্যাক্সিনবিরোধী ক্যাম্পেইন করে ( যেমন- ল্যারি কুক) তাদের অধিকাংশই রিপাবলিকান দলকে সমর্থন করে।
করোনা প্যান্ডেমিকের শুরুতে ট্রাম্প অনেকদিন মাস্ক পরেননি। মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াতেন। করোনাভাইরাসকে ‘উহান ভাইরাস’ কিংবা ‘চায়না ভাইরাস’ বলতেন। চায়নার ল্যাব থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে দাবি করতেন ।
করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রচুর মিথ্যা সংবাদ তিনি ছড়িয়েছেন। তবে ২০২১ সালের ১লা মার্চ তিনি টিকা গ্রহণ করেছেন।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারো , ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহ অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই করোনা ইস্যুতে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়িয়েছেন।
ইউরোপের অনেক দেশে সবার জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব দেশের বিরোধী দলগুলো জনগনের ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে বাধ্যতামুলক টিকার বিরোধিতা করছে।
উদাহরণস্বরূপ- ফ্রান্সে বাধ্যতামূলক টিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিরোধী মেরিন লা পেন এবং ফ্লোরিন ফিলিপট এর দল। ট্যাক্সিচালকদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ‘ইয়েলো ভেস্ট’ দেরকেও অনেকদিন পর এই টিকা ইস্যুতে রাজপথে সরব হতে দেখা গেছে।
৭। বিভিন্ন ধর্মগুরুরা
১৭২২ সালে ইংল্যান্ডের খৃষ্টান ধর্মগুরু Reverend Edmund Massey বলেছিলেন, ঈশ্বর মাঝে মাঝে তার কোনো কোনো বান্দাকে তার পাপের শাস্তি হিসেবে স্মল পক্স বা অন্য কোনো দূরারোগ্য রোগ দেন । সবারই উচিত তার পাপের শাস্তি মাথা পেতে নেওয়া। টিকা দিয়ে যদি স্মল পক্স ঠেকিয়ে দেয়া হয়, তার মানে তো ঈশ্বরকে তার শাস্তি দিতে বাধা দেওয়া ! এটা তার কাজে হস্তক্ষেপ করা হয়ে যায়। সুতরাং সকল প্রকার টিকা বন্ধ করা উচিত। ঈশ্বরের কাজে বাধা দেওয়া উচিত না। যার ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে।
৩০০ বছর আগে শুরু হওয়া এই বিতর্ক এখনো চলছে। এখনো অনেকে এই যুক্তি ব্যবহার করেন টিকা-বিরোধী প্রচারণায়। আমেরিকায় Amish নামে একটা কট্টরপন্থী খৃষ্টান গ্রুপ আছে, যারা ১৬০০ সেঞ্চুরির লাইফস্টাইলে চলে। তারা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, মোবাইল সহ কোনো ইকেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেনা এবং বলাই বাহুল্য, তারা টিকাও নেয় না।
কিছু কিছু টিকা ( যেমন রুবেলা ভ্যাক্সিন) বানাতে ব্যবহার করা হয় ভ্রূণের স্টেম সেল। গোড়া ক্যাথলিক ধর্ম স্টেম সেল নিয়ে সকল গবেষণা নিষেধ করে। এ কারণে এই সকল টিকাও তারা নিষেধ করেছে।
ইহুদি এবং মুসলিম কমুনিটির মধ্যেও অনেকে জেলাটিন সমৃদ্ধ ভ্যাক্সিন নিতে চান না। কারণ এই জেলাটিনের মধ্যে শূকরের চর্বি থাকে, যেটা এই দুই ধর্মের মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ।
আগস্ট,২০২০ এ অস্ট্রেলিয়ান ইমাম ,সুফিয়ান খলিফা বলেছিলেন, অক্সফোর্ডের করোনার টিকা হারাম। এটা না নিতে তিনি মুসলিমদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ডিসেম্বর ২০২০ এ ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে টিকা হালাল-হারাম নিয়ে বড় আকারে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এরপর মসজিদের মধ্যে টিকাকেন্দ্র স্থাপন করে টিকা দেয়া শুরু হয়।
অনেক মুসলিম স্কলার বলেন, চিকিৎসার জন্য এ্যালকোহল বা শূকরের মাংসের ব্যবহারে সমস্যা নেই।
গত ২৪শে জুলাই ২০২১ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এক পোস্ট এর মাধ্যমে জানাচ্ছে, কোভিড-১৯ টিকা হালাল।
৮। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী
স্মল পক্স একসময় পৃথিবীতে খুব ভয়ংকর রোগ ছিল। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ মারা যেত এই রোগে। তবে বর্তমানে এই রোগ আর নেই । ১৯৮৬ সালের পর এই রোগ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে এই রোগের টিকা দিয়ে রোগ জীবাণুটাকে নির্মূল করে ফেলা হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের একটা বড় রোগ পোলিও। বাংলাদেশে প্রতিবছর পোলিও খাওয়ানো হয় বাচ্চাদের। ”বাদ যাবে না একটি শিশুও” স্লোগান নিয়ে এই প্রচারণায় ১০০% বাচ্চাকে টিকার আওতায় আনা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এইভাবে পোলিও টিকা খাওয়ানো হয়। কেবলমাত্র পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে এই পোলিও কর্মসূচি চালানো যায় না। কারণ সেখানে তালেবান-এর দাবি, এই টিকা খৃষ্টান মিশনারিরা খাওয়াচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। যে খৃষ্টান মিশনারিদের এই টিকা খাবে, তার ঈমান থাকবে না, সে খৃস্টান হয়ে যাবে। টিকার সাথে অন্য ক্ষতিকর জিনিসও মিশিয়ে দিচ্ছে। এই টিকা নিলে ছেলেমেয়েরা বন্ধ্যা হয়ে যাবে — এমন গুজব চালু রয়েছে সেখানে।
পাকিস্তান আর আফগানিস্তান যে যে জায়গায় টীকা ক্যাম্প বসায়, সেখানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আক্রমণ করে নিয়মিত। এলাকার মানুষদেরকেও তারা হুমকি দেয়, কেউ যেন টীকা নিতে না যায়। স্থানীয় ধর্মীয় মৌলবাদীরা “ভ্যাক্সিন নেওয়া হারাম” জানিয়ে ফতোয়া জারি করে। প্রতিনিয়ত টীকা দান কর্মী এবং ডাক্তার দের হত্যা করে। সর্বশেষ ১৬ই জুন,২০২১ তারিখে জালালাবাদে চারজন টীকাদান কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাত পরিচয় সন্ত্রাসীরা ।
এ সকল গ্রুপের কারনেই এইসব এলাকায় পোলিও নির্মূল হচ্ছে না । প্রতিবছর কয়েক হাজার পোলিও রোগী পাওয়া যাচ্ছে ওই জায়গা থেকে। শুধুমাত্র এই দুইটা দেশের কারণে বিশ্বকে পোলিওমুক্ত করা যাচ্ছে না।
৯। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে চান যারা
শরীরে টিকা নিলে মাঝে মাঝে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যেমন- হামের টিকা নিলে শরীরে জ্বর বা ছোট ছোট ফুস্কুড়ি উঠতে দেখা যায়। কোভিড-১৯ এর টিকার ক্ষেত্রেও, টিকা-পরবর্তী সময়ে শরীরে জ্বরসহ বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেক অভিভাবক এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে ভয় পায়। ভাবে , টিকা নেয়ার ফলে আমার বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে । ফলে তার জ্বর আসছে। এ কারণে তারা টিকার পরবর্তী ডোজ নিতে যায় না বা অন্য বাচ্চাদের অভিভাবককেও নিরুৎসাহিত করে।
অনেকে আবার এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা শুনে প্রথম থেকেই টিকাবিদ্বেষী থাকে। কোনো ডোজই নেয় না।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
২০২১ এর জানুয়ারিতে প্রথম আলোর এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী ,১৮% দ্বিধাগ্রস্থ এবং ৮% টিকা নিয়ে অনাগ্রহী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে টিকা নিয়েছেন। সবাইকে টিকা নিতে উৎসাহিত করছেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও টিকা নিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোও টিকা-বিরোধী কোনো কর্মসূচি দেয় নি। তবে জামায়াতে ইসলামীর একটি গ্রুপকে পুলিশ আটক করেছে গত ২৮শে জুলাই। পুলিশের দাবি, এরা লকডাউন-বিরোধী বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছিল।
ওলামা লীগ নামের একটি দল সমাবেশ এবং মানব বন্ধন থেকে দাবি করেছিল, ছোঁয়াচে রোগ নামে কিছু নাই। এবং করোনা মোকাবেলার জন্য লকডাউনের দরকার নেই। তবে টিকা নিয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায় নি এখনো।
রাজারবাগ দরবার শরীফসহ কয়েকটি ধর্মীয় গ্রুপ এই করোনাভাইরাস এবং ছোঁয়াচে রোগকে অস্বীকার করে দেয়াল লিখন, মাইকিং এবং লিফলেট বিতরণ করেছে। ২৮শে মার্চ ২০২০ তারিখে বিভ্রান্তিকর লিফলেট ছড়ানোর দায়ে রাজারবাগ শরীফের ৬ জন কর্মীকে গ্রেফতার ও করা হয়েছিল।
কয়েকটি ফেসবুক পেজ (যেমন নয়ন চ্যাটার্জি কিংবা শ্রাবণ ইস্পাহানি) থেকে বলা হচ্ছে, টিকা নিলেই করোনা আক্রান্ত হচ্ছে জনগণ। ব্যবসায়িক স্বার্থে বিভিন্ন দেশ বাধ্য করছে সবাইকে ভ্যাক্সিন গ্রহণ করতে।
রাজিব আহামেদ নামের এক লেখক ন্যাচারোপ্যাথি নিয়ে ফেসবুকে বেশ মার্কেটিং করছেন।এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, টীকা ক্ষণস্থায়ী, ইম্যুনিটি স্থায়ী। বিভিন্ন সময়েই করোনা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন তিনি।
জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা কাজী ইব্রাহিম সহ কয়েকজন ধর্মীয় বক্তা বলেছিলেন, ইহুদি বিল গেটস টিকা বানাচ্ছে সবাইকে ইহুদি বানানোর জন্য। এই ইহুদি পণ্য বর্জন করা উচিত। পশ্চিমারা এর আগেও টিকার মধ্যে খারাপ জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছে। আফ্রিকায় পোলিওর টিকার মধ্যে এইডস এর জীবাণু মিশিয়েছিল। বাংলাদেশের টিকায়ও এরা বিষ ঢুকিয়ে দিবে। বিভিন্ন রকম সাইড ইফেক্ট দেখা দিবে।
যদিও কিছু কিছু ধর্মীয় বক্তাদের কাছ থেকে এর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী গত ২রা আগস্ট ২০২১ তারিখে করোনার টিকা নিয়েছেন এবং ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে অন্যদেরও টিকা নিতে উৎসাহিত করেছেন।
শেষ কথা
সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন দেশেই টিকা-বিরোধী বিভিন্ন গ্রুপের কর্মকাণ্ড চলে আসছে। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর টিকা-বিরোধীদের কার্যক্রম বেড়েছে। তারা বিভিন্ন ফোরামে কোভিড টিকাবিরোধী ( এবং পর্যায়ক্রমে সকল টিকাবিরোধী) মতামত তুলে ধরছে ।
করোনা-মহামারি ঠেকাতে টিকার বিকল্প নেই। টিকা কিংবা করোনা ইস্যুতে গুজবে কান না দিয়ে সঠিক তথ্য যাচাই করে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত প্রত্যেকের ।
(ফিচার্ড ইমেজ হিসেবে ব্যবহৃত ছবিটি কাইসার হেলথ নিউজ এর সৌজন্য প্রাপ্ত)
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
|
No Factcheck schema data available.