সম্প্রতি ‘এপ্রিলফুল’নিয়েবিভিন্ন প্রপাগান্ডামূলক ভিডিও এবং পোস্ট ভাইরাল হয়েছে।এসবপোস্টেদাবিকরাহচ্ছে,১৪৯২সালের১লাএপ্রিলখ্রিষ্টানরাজাফার্ডিন্যান্ডএবংরাণীইসাবেল৭লক্ষমুসলিমকেধোঁকাদিয়েপুড়িয়েএবংডুবিয়েমেরেফেলেছিল।
এইধরণেরপোস্টপ্রতিবছরই১লা এপ্রিল এর কাছাকাছি সময়ে ভাইরালহয়। তবেফ্যাক্টওয়াচেরঅনুসন্ধানেজানাযাচ্ছে১৪৯২সালের২রাজানুয়ারীখ্রিষ্টানরাজাফার্ডিন্যান্ডএবংরাণীইসাবেলইউরোপেরশেষমুসলিমরাজ্যগ্রানাডাদখলকরে।তারাগ্রানাডাদখলকরারআগে১৪৯১সালের২৫নভেম্বরগ্রানাডাআমিরাতেরসুলতানমোহাম্মাদ–১২বোআব্দিলেরসাথেমুসলমানদেরসুরক্ষারজন্যগ্রানাডাচুক্তিসইকরে।একারণেসেইসময়ফার্ডিন্যান্ডএবংইসাবেলেরপক্ষে৭লক্ষমুসলমানহত্যাকরাসম্ভবছিলোনা।তাই১৪৯২সালের১লাএপ্রিল৭লক্ষমুসলমানহত্যারতথ্যটিভূল।
সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ওয়াজের ভিডিওগুলোতে মাসুদ সাঈদী নামে একটি মনোগ্রাম দেখা যাচ্ছে। মাসুদ সাঈদীর ফেসবুক আইডিতে গেলে দেখা যায় তিনি ১লা এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর এপ্রিল ফুল নিয়ে করা ওয়াজটি পোস্ট করেন। পোস্টের ক্যাপশনে লেখেন “জানুন ‘এপ্রিলফুল‘ এরইতিহাস …
ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলোয় দাবি করা হয়েছে, ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল স্পেনের গ্রানাডায় মুসলিম শাসক ক্ষমতাচ্যুত হলে খ্রিষ্টানরা ৭ লক্ষ মুসলমান পুড়িয়ে এবং ডুবিয়ে মারে।
১লা এপ্রিল ২০২৩ তারিখে বিবিসি “’এপ্রিল ফুল’ এর সাথে কি মুসলমানদের ট্র্যাজেডি জড়িয়ে আছে?” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন এপ্রিল ফুল দিবসের সাথে স্পেনের মুসলিম শাসকদের পরাজয়ের ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই। তিনি বলেন “এটি আমরাও শুনেছি এবং এটি একরকম আমাদের বিশ্বাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যখন স্পেনের ইতিহাস পড়েছি, দেখেছি যে সেসময় গ্রানাডার শাসক ছিলেন দ্বাদশ মোহাম্মদ। তার কাছ থেকেই ফার্দিনান্ড ও ইসাবেলা গ্রানাডা দখল করে নেন। আর এ ঘটনাটি ঘটেছিল জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে। কোন কোন সূত্র বলে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ। এবং এটি দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হয়েছিল।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলছেন, সেসময় ফার্দিনান্ড ও ইসাবেল মুসলমানদের উপর নির্যাতন করেছে, ইহুদিদের উপরও করেছে। কিন্তু এপ্রিল ফুলের যে ট্র্যাজেডির কথা বলা হয়, তার কোন সত্যতা পাওয়া যায় না।
গ্রানাডা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে ১৪৮২ সাল থেকে ১৪৯১ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক রাজারা, কাস্টলের রানী ইসাবেল এবং আরাগনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড নাসরিদ রাজবংশ এবং গ্রানাডা আমিরাতের উপর যৌথবাহিনী গঠন করে সেনা অভিযান চালায়। এই যুদ্ধ অবিরতভাবে দশ বছর ধরে হয়নি। যৌথ বাহিনী এই যুদ্ধে সিরিজ হামলা করতো। সিরিজ হামলাগুলো বসন্তকালে শুরু হতো এবং শীতকালে শেষ হত। এ সময়কালে গ্রানাডার মুসলিমরা নিজেদের মধ্যেও কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে এবং গৃহযুদ্ধ করে। কিন্তু খৃস্টান সেনাবাহিনী ছিলো ঐক্যবদ্ধ। গ্রানাডিয়ানরা অর্থনৈতিকভাবেও ভেঙ্গে পড়েছিল, কারণ তাদের হামলা থেকে বাঁচার জন্য কাস্টলের রাণী ইসাবেলকে রাজস্ব দিতে হতো। ১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী গ্রানাডা আমিরাতের রাজা মোহাম্মাদ-১২ বোআব্দিল তার সৈন্য নিয়ে গ্রানাডা শহর এবং আলহামব্রা শহরে আত্মসমর্পণ করেন।
অর্থাৎ, ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল কোনো যুদ্ধই হয়নি, কারণ ১৪৯২ এর ২রা জানুয়ারি তারিখেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারির আগে ১৪৯১ সালের ২৫শে নভেম্বর গ্রানাডা চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল ,যেখানে পক্ষ থেকে চুক্তিটি সাক্ষর করেন গ্রানাডা আমিরাতের সুলতান বোআব্দিল এবং খ্রিষ্টানদের পক্ষ থেকে কাস্টলের রানী ইসাবেল এবং আরাগনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিলো মুসলমানদের অধিকার সমুন্নত রাখা এবং মুসলমানদের ধর্মীয় রীতি নীতি পালনে বাধা না দেওয়া। এই চুক্তিতে মোট ৬৯টা ধারা ছিলো যার ভিতর উল্লেখযোগ্য কিছু ধারার ছবি নিচে দেওয়া হলো।
২৮ জুন, ২০১৭ সালে ইজিপ্ট টুডে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে ২রা জানুয়ারী, ১৪৯২ তারিখে সেনাবাহিনী গ্রানাডায় প্রবেশ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ মুসলিম রাজ্য আল-আন্দালুস দখল করে। সেই সকালে খ্রিস্টান সৈন্যরা আল-হাম্ব্রা প্রাসাদ দখল করে। তারা দেয়ালে স্পেনের খ্রিস্টান রাজাদের ব্যানার এবং পতাকা ঝুলিয়ে দেয়, তাদের বিজয়ের ইঙ্গিত দেয় ।
উক্ত দিকগুলো বিবেচনা করে বলা যায় ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল মুসলিমদের উচ্ছেদ ও হত্যা করা হয়নি। ১৪৯১ সালের ২৫ নভেম্বর গ্রানাডা আমিরাতের সুলতান বোআব্দিল তার রাজত্বের পতন সুনিশ্চিত জেনে খ্রিষ্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রাণী ইসাবেলের সাথে মুসলিমদের সুরক্ষায় একটি চুক্তি করেন। ১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারী খ্রিষ্টানরা গ্রানাডা দখল করে নেয়। অর্থ্যৎ ১লা এপ্রিল খ্রিষ্টানদের স্পেন দখলের তথ্যটি ভূল। এবং এই সময় মুসলমান এবং ইহুদিদের নির্যাতন এবং ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করলেও ৭ লক্ষ মুসলমান হত্যা করা হয়েছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া
এপ্রিল ফুল ডে পালন কিভাবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম লোককাহিনী প্রচলিত আছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ব্রিটানিকা, হিস্ট্রিসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইট এর বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি হয় ফ্রান্সে। আর সেটা ১৫০০ শতকে, যখন ক্যালেন্ডার বদল ঘটে। তার আগ পর্যন্ত ইউরোপে বছরের হিসেব হতো এপ্রিলের এক তারিখ থেকে। এপ্রিল নামকরণ থেকেও ব্যাপারটা বোঝা যায়। ইংরেজি April শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Aperire থেকে, যার অর্থ হল শুরু করা। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সে নতুন ক্যালেন্ডার চালু করাকে কেন্দ্র করে এপ্রিল ফুল ডে’র সুচনা হয়। ঐ ক্যালেন্ডারে ১লা এপ্রিলের পরিবর্তে ১লা জানুয়ারীকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে কিছু লোক তার বিরোধিতা করে। যাঁরা পরিবর্তনটি মেনে নেন, তাঁদের বোকাও বানাতে থাকেন। তাঁদের পিঠে কাগজের তৈরি মাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়। নতুন ক্যালেন্ডারের পক্ষ যাঁরা, তাঁদের ডাকা হত এপ্রিল ফিশ বলে। সেই থেকেই এপ্রিল ফুলের গল্প শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা স্নোপস ও একই কথা জানাচ্ছে।
তবে এপ্রিল ফুল দিবস নিয়ে মুসলমানদের ট্রাজেডির কোন ইতিহাস কোন বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া যায়নি।
এপ্রিল ফুল নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখতে পাবেন বিবিসি বাংলা , হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা এবং ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান যাচাই এর প্রতিবেদনে। তারাও তাদের প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, ইতিহাসের এই দিনে লাখ লাখ মুসলিমদেরকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করার কোনো দলিল পাওয়া যায় না।
সার্বিক দিক বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?