যা দাবি করা হচ্ছে :রংপুরে ইসকন মন্দিরে এবং করুণাময়ী কালী মন্দিরে হামলা করা হয়েছে। এছাড়া রংপুর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কাজল রায় কে হত্যা করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে যা পাওয়া যাচ্ছে : ৪ই আগস্ট তারিখে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে সংঘর্ষে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হারাধন রায় সহ কয়েকজন নিহত হয়। তবে কাজল রায় নামে কারো নিহতের তথ্য জানা যায়নি। তাছাড়া, কাউন্সিলর হত্যাকাণ্ডটি সরকার পতনের আগেই ঘটেছিল, ফলে এর সাথে আওয়ামী লীগ-পরবর্তী নাশকতার ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।
উল্লেখিত দুইটি মন্দিরে হামলার কোনো খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া রংপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে বলছেন যে রংপুরে কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেনি।
গুজবের উৎস
গত ৪ আগস্ট রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে ভারতীয় জনতা পার্টি -বিজেপি’র প্রদেশ মিডিয়া ইনচার্জ সুনীত সরোকার (Sunit Sarkar) একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, রংপুরে ইসকন মন্দিরে হামলা এবং হিন্দুদের ঘর-বাড়ি ভাংচুর করেছে দূর্বৃত্তরা! রংপুরের বিখ্যাত করুণাময়ী কালী মন্দিরে আক্রমণ। সম্ভবত মন্দিরের ভক্তরা মন্দির থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার জন্য পলায়নও করেছে।
* আন্দোলনের নামে খুনীরা রংপুর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কাজল রায় কে হত্যা করেছে।
৫ই আগস্ট রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে জনৈক দীপু পাল একটি পোস্টে লেখেন,
১. আজকে চলমান আন্দোলন ও সংহিসতাকে কেন্দ্র করে রংপুরে ইসকন মন্দিরে হামলা এবং হিন্দুদের ঘর-বাড়ি ভাংচুর করেছে দূর্বৃত্তরা! রংপুরের বিখ্যাত করুণাময়ী কালী মন্দিরে আক্রমণ। সম্ভবত মন্দিরের ভক্তরা মন্দির থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার জন্য পলায়নও করেছে।
* আন্দোলনের নামে খুনীরা রংপুর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কাজল রায় কে হত্যা করেছে।
২. নোয়াখালীতে হিন্দু বাড়িতে জ**ঙ্গিদের আ**ক্রমন।
৩. পঞ্চগড়ের হিন্দু মন্দিরে আ**ক্রমণ। নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য পলায়ন৷
গত ৪ই আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত রংপুর রণক্ষেত্র, সিটি কাউন্সিলরসহ নিহত ৪ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, (রংপুরের) টাউন হল সড়ক থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান কর্মসূচী রোববার (৪ আগস্ট) বেলা ১২টার দিকে নগরীর ভাঙ্গা জামে মসজিদ এলাকায় আসে। সেখানে বিএনপি ও জামায়াত তাদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়। বেলা সাড়ে ১২টায় দলীয় কার্যালয় থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের শতাধিক নেতা-কর্মী দেশীয় অস্ত্র, লাঠি-সোটা, ইট-পাটকেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে আন্দোলনকারীরাও লাঠি-সোটা, ইট-পাটকেল নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় ঘটনাস্থলে নগরীর গুড়াতি পাড়ার মাহবুব আলমের ছেলে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা খাইরুল ইসলাম সবুজ (২৮), মাসুম (৩০), সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হারাধন রায় ও দেহরক্ষী শ্যামল নিহত হন।
৫ই আগস্ট রাত ১২টা ১২ মিনিটে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত রংপুরে কাউন্সিলরসহ নিহত ৫ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবিতে ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় রংপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। সাংবাদিকসহ প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে কয়েকজন গুরুতর অবস্থায় মেডিকেলে ভর্তি রয়েছেন। গতকাল রোববার দুপুরের দিকে রংপুর নগরীতে সংঘর্ষ চলাকালে এই ঘটনা ঘটে। নিহত হারাধন রায় রংপুর সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, পশুরাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রসিক কাউন্সিলর শাহাজাদা আরমান শাহাজাদা। নিহত অন্য চারজন হলেন- নগরীর গুড়াতিপাড়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা খরশু মিয়া, যুবলীগ নেতা মাসুম, হারাধন রায়ের ভাগ্নে এবং অপরজনের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে ৩৩ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ১১ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের নামের একটি তালিকা পাওয়া যাচ্ছে।এই তালিকার ১৫ নম্বরে হারাধন রায় এর নাম দেখা যাচ্ছে । তিনি নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তবে সম্পূর্ণ তালিকার কোথাও ‘কাজল রায়’ নামের কোনো কাউন্সিলরের নাম পাওয়া গেল না।
পূর্বোক্ত দুইটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ৪ই আগস্ট তারিখে আন্দোলনকারীরা রংপুরের সাবেক এমপি আশিকুর রহমানের বাড়ি ও অফিস এবং পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছিল। এছাড়া রংপুর-২ (বদরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি ডিউক চৌধুরীর বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন এবং পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। সেই সাথে মিঠাপুকুর উপজেলার পরিষদ চত্বরে ইউএনও অফিস, বেগম রোকেয়া অডিটোরিয়াম, আনসার ভিডিপিসহ বিভিন্ন দপ্তরে আগুন দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। তবে এসব প্রতিবেদনের কোথাও মন্দিরে হামলার কোনো তথ্য জানানো হয়নি। অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমেও রংপুরের ইসকন মন্দিরে বা করুণাময়ী কালী মন্দির বা অন্য কোনো মন্দিরে হামলার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
৯ই আগস্ট তারিখে রংপুরে বৈষম্যবিরোধী নাগরিক ঐক্য এর ব্যানারে একটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ নিশ্চিত করেন যে, রংপুরের কোনো মন্দিরে সম্প্রতি কোনো হামলা বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। এ সংক্রান্ত যমুনা টেলিভিশনের দুইটি প্রতিবেদন দেখা যাবে এখানে এবং এখানে।
কিছু কিছু ফেসবুক পোস্টে রংপুরের হামলা বা হতাহতের খবরের সাথে সাথে দেশের অন্যান্য এলাকায় বিভিন্ন হামলার খবর দেওয়া হচ্ছে (যেমন পঞ্চগড়,নোয়াখালী,সিরাজগঞ্জ)। এই দাবিগুলোতে নির্দিষ্টভাবে স্থানের নাম উল্লেখ না থাকায় ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিগুলো যাচাই করতে পারে নি।
সিদ্ধান্ত
রংপুর সিটি কর্পোরেশনে কাজল রায় নামে কোনো কাউন্সিলর নেই। ৪ আগস্ট সংঘর্ষে হারাধন রায় নামে একজন কাউন্সিলর সহ কয়েকজন নিহত হন।তবে হতাহতদের মধ্যে কাজল রায় নামে নিহত কাউকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া রংপুরের ইসকন মন্দির বা করুণাময়ী কালী মন্দির বা অন্য কোনো মন্দিরে সুনির্দিষ্ট হামলার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, বরং রংপুরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেছেন যে রংপুরে এমন কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোকে ‘আংশিক মিথ্যা’ সাব্যস্ত করেছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।