যা দাবি করা হচ্ছে: বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সাথে ‘নওমি’ নামের একজনের ফোনালাপ ফাস হয়েছে। এখানে জনাব আমীর খসরুকে উক্ত ছাত্রনেতার প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা দিতে শোনা গিয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, নওমি চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক।
অনুসন্ধানে যা পাওয়া যাচ্ছে: চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক টিমে ‘নওমি’ নামের কেউ নেই। বরং ২০১৮ সালে সেই সময়কার কোটা আন্দোলনে ফাঁস হওয়া ফোনালাপ ছিল এটি। এই ফোনালাপের সূত্র ধরে জনাব আমীর খসরু এবং তৎকালীন ছাত্রদল নেতা নওমি দুজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই অডিও ক্লিপকেই সাম্প্রতিক সময়ের বলে দাবি করা হচ্ছে।
খসরু – হ্যালো
নওমি- জ্বি, আসসালামুয়ালাইকুম আংকেল
খসরু- হ্যাঁ,হ্যাঁ, নওমি
নওমি- আংকেল,নওমি বলছিলাম।
খসরু -হ্যাঁ,হ্যাঁ, ভাল আছো?
নওমি-জ্বি আংকেল, আলহামদুলিল্লাহ
খসরু- হ্যাঁ ,হ্যাঁ, আছি ভালো। তোমরা কি ইনভলভ টিনভল্ভ হচ্ছো এগুলোতে, নাকি ?
নওমি- জ্বি ,জ্বি, আংকেল। আমিতো ওই যে কুমিল্লায় আসলাম আরকি।
খসরু -না না কুমিল্লা না। নামাইয়া দাও না। তোমাদের মানুষজনদের সব নামাইয়া দাও না
নওমি- হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ
খসরু-বুঝছো? কুমিল্লার পর ঢাকায়ই যাও।
নওমি-জ্বি,জ্বি,জ্বি।
খসরু -মানুষজন নামাইয়া দাও ভালো করে। তোমাদেরকে কেউতো চিনে না।
নওমি-না, না,না।
খসরু-বুঝছো, তোমাদের সব বন্ধুবান্ধব নিয়া নাইমা পড়ো না ঢাকায় ?
নওমি- জ্বি,জ্বি,জ্বি, কন্টাক্ট করতেছি সবার সাথে ।
খসরু -কন্টাক্ট করো।কখন আর কন্টাক্ট করবা? এখনই তো টাইম। আর কবে?
নওমি-জ্বি জ্বি জ্বি
খসরু- এখন নামতে না পারলে তো আবার ডাউন করে যাবে
নওমি- হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ
খসরু-তোমাদের তো এত পরিচিত মুখ না। বন্ধু বান্ধবদের —
নওমি-জ্বি,জ্বি,জ্বি। এখানে একটু হাইওয়েতে নামছিল। ওইযে ঢাকা চিটাগাং, ওখানে এমপি সাহেবের গাড়ি গেছিল। সবাইকে একটু সরাইয়া দিছে।
খসরু-না,না,অসুবিধা নাই। হাইওয়ে থাকুক অসুবিধা নাই। ঢাকায় নামাইয়া দাও।
নওমি-জ্বি,জ্বি,জ্বি।
খসরু-ঢাকা হইলে সারাদেশে এম্নেই হয়ে যাবে। তোমরা ঢাকায় এসে…।।এখানে,ওখানে,কুমিল্লায় তো দরকার নাই আমার।
নওমি-জ্বি ,জ্বি, জ্বি।
খসরু-তোমরা ঢাকায় এসে তোমাদের বন্ধু বান্ধব নিয়ে,দুই-চারশো-পাচশো জন নিয়ে জয়েন করে যাও।বুঝছো ?
নওমি-জ্বি। এমনি সবাই সংহতি জানাচ্ছে। এমনে ঐ…।।
খসরু-সংহতি দিয়ে কি লাভ হবে। তোমাদের মত যারা আছো, নেমে যাও না ?
নওমি-জ্বি আংকেল।
এই কথোপকথন থেকে ঘটনার সময় সম্পর্কে কিছু আঁচ করা যাচ্ছে না।
তবে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে এই অডিও সংলাপটি খুজে পাওয়া গেল। দেখা গেল, ২০১৮ সালেই এই কল রেকর্ডটি ফাস হয়েছিল। চ্যানেল আইয়ের ভেরিফাইড ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৮ সালের ৪ঠা আগস্ট তারিখে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে আমীর খসরুর ফোনালাপ ফাঁস শীর্ষক প্রতিবেদনে এই অডিও রেকর্ডটা পাওয়া যাচ্ছে। এখাঙ্কার সংলাপের পুরো অংশটাই পূর্বোক্ত সংলাপের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বাড়তি অংশ হিসেবে চ্যানেল আইয়ের অডিওটায় কেবলমাত্র জনাব খসরুকে ফেসবুকে লেখালেখি করার উপদেশ দিতে শোনা যায়।
সেসময় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর এই কল রেকর্ড ফাস নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন ও প্রকাশিত হয়েছিল। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখতে পাবেন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে অডিও কল রেকর্ডিংটি সাম্প্রতিক নয়, বরং এটি ২০১৮ সালের সময়কার।
এসব প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটি ছিলেন ছাত্রদল নেতা মিলহানুর রহমান নাওমী। ২০১৮ সালের ৫ই আগস্ট তাকে কুমিল্লা থেকে আটক করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট দুইজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (সংশোধিত ২০১৩৫৭ (২) ধারা) এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫ (৩) ধারায় দায়ের করা ওই মামলার এজাহারে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা এবং উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
ওই মামলায় ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর উচ্চ আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের মেয়াদ শেষে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া মামলায় আদালতের নির্দেশে ব্যারিস্টার মিলহানুর রহমান নওমীকেও আসামি করা হয়। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের একটি আদালতে পুলিশ তাকে হাজির করলে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের দিন আসামিদের খালাস দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১২ই জুন এই মামলার বিচারকাজ পুনরায় শুরু হলেও এখনো কোনো চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাচ্ছেনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক একটি আনভেরিফাইড পেজ থেকে গত ৮ই জুলাই চলমান আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক টিম’ এর একটি তালিকা দেয়া হয়েছিল। এই তালিকায় ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক সহ মোট ৬৫ জন ছিল। এদের মধ্যে নওমি বা নাওমি বা মিলহানুর রওমান নামে কাউকে পাওয়া গেল না।
অর্থাৎ, যেসকল ফেসবুক পোস্টে ফোন কলের অপর প্রান্তে থাকা নওমি এর পরিচয় হিসেবে সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন উল্লেখ করা হয়েছে, সে দাবীটি সঠিক নয়।
অর্থাৎ,ছড়িয়ে পড়া এই ফেসবুক পোস্টের দু’টি দাবীই ভুল প্রমাণিত হল। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এই সকল পোস্টকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।