‘ব্রেকিং নিউজ : পৃথিবীর সামনে মহাবিপদ’ শিরোনামে একটি খবর ভাইরাল হয়েছে। অনেক ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপ থেকে শিরোনাম সামান্য এদিক ওদিক করে এই খবরটা শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে। খবরে বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে একটি গ্রহাণু আছড়ে পড়তে যাচ্ছে, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। অধিকাংশ খবরেই কোনো দিন-তারিখ নেই, প্রেক্ষাপট নেই। ফলে এ ধরনের খবর মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে, নিকট ভবিষ্যতে এমন বিপজ্জনক কোনো গ্রহাণুর পৃথিবীতে আঘাত করার সম্ভাবনা নেই।দূর ভবিষ্যতে এমন সম্ভাবনা থাকলেও তা খুবই ক্ষীণ। আর এই সম্ভাবনাটুকুকে বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রচার করলে জনমানসে বিভ্রান্তির সুযোগ থাকে।
খবরের উৎস
গত ১২ জুলাই সকাল থেকে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই খবরটা ভাইরাল হতে দেখা যায় । মূলত বিভিন্ন পেজে এবং গ্রুপে কয়েকটি স্বল্প পরিচিত সংবাদমাধ্যমের নিউজ লিঙ্ক শেয়ারের মাধ্যমে এটি ছড়াতে থাকে।
কয়েকটা পেজে আবার কাল্পনিক গ্রহাণুর ছবি ভীতিকরভাবে ছবির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে । যেমন-
ফেসবুক পেজে শেয়ার করে একটি খবর ক্লিক করে tingiday ওয়েবসাইটে গিয়ে মূল খবরে দেখা যাচ্ছে, বলা হয়েছে, ‘’ মহাবিপদে রয়েছে পৃথিবী। কারণ, এর দিকে ধেয়ে আসছে ৮ কোটি টনেরও বেশি ওজনের মহাদৈত্যাকার গ্রহাণু। ভয়ংকর গতিবেগের ১৬৪০ ফুট চওড়া গ্রহাণু থেকে রেহাই পেতে আমেরিকা, ইউরোপের কয়েকটি দেশের মতো মরিয়া হয়ে উঠেছে চীনও। সম্প্রতি এ খবর জানিয়েছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, হিরোশিমায় পড়া ৮০ হাজার পরমাণু বোমা একসঙ্গে পড়লে যে শক্তির জন্ম হতো, ওই শক্তি নিয়েই গ্রহাণুটি আছড়ে পড়তে পারে পৃথিবীতে। আর তাতে মারা যাবে পৃথিবীর লাখ লাখ লোক।
চীনের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা চায়না ন্যাশনাল স্পেস সায়েন্স সেন্টারের বিজ্ঞানীরা ওই ধেয়ে আসা গ্রহাণুটির অভিমুখ পৃথিবী থেকে অন্য দিকে ঘোরানোর পরিকল্পনা করছেন। এজন্য তারা মহাকাশে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে চাইছেন খুব শক্তিশালী ২৩টি সর্বাধুনিক লং মার্চ-৫ রকেট পাঠিয়ে। যেগুলো পালাক্রমে ছুটে যাবে গ্রহাণুটির দিকে। গ্রহাণুর গায়ে গিয়ে ঘটাবে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। আর তাতেই এর গতিপথ ঘুরে যেতে পারে বলে মনে করছেন চীনের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। ‘’
খবরটি প্রকাশিত হয়েছে ১১ই জুলাই তারিখে।
একই খবর দৈনিক যুগান্তরে দেখা গিয়েছে ১২ই জুলাই তারিখে যেটা অনলাইন পোর্টাল টিঞ্জি ডে এর হুবহু কপি। যুগান্তরের খবরটার আর্কাইভড ভার্সন দেখুন এখানে।
এই খবরে কোনো নির্দিষ্ট দিন তারিখের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ , কবে এই গ্রহাণু আঘাত করবে সে বিষয়ে কোনো তারিখ বা সম্ভাব্য তারিখ বলেনি।
আরটিভি অনলাইন এর খবরের শিরোনাম– বেনু ধেয়ে আসায় মহাবিপদে পৃথিবী, মারা যাবে লাখ লাখ মানুষ । এই খবরের বিবরণে সম্ভাব্য তারিখ পাওয়া গেল। আরটিভি লিখেছে, গ্রহাণুটির নাম দেয়া হয়েছে ‘বেনু’। ৭ দশমিক ৮ কোটি টনের গ্রহাণুটি আগামী ১৫০ বছরে পৃথিবীর কক্ষপথের ৭৫ লাখকিলোমিটারের মধ্যে চলে আসবে।
তবে আরটিভির ১৩ তারিখে প্রকাশিত এই খবরটার সাথে মিল পাওয়া গেল ১২ তারিখে প্রকাশিত লাইটনিউজবিডি ওয়েব পোর্টালের এই খবরটার সাথে।
ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধান
101955 Bennu নামের গ্রহাণু এর উইকিপিডিয়া পেজে বলা হয়েছে, ২১৭৫ সাল থেকে ২১৯৯ সালের মধ্যে এই গ্রহাণুটির পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনা রয়েছে ২৭০০ ভাগের এক ভাগ (It has a cumulative 1-in-2,700 chance of impacting Earth between 2175 and 2199)
আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ওয়েবসাইটে বেনু সম্পর্কে বলা হয়েছে, বেনুকে সম্ভাব্য ক্ষতিকর বস্তু হিসেবে ধরা হচ্ছে কারণ এটি পৃথিবীর ৭৫ লাখ কিলোমিটার মধ্যে চলে আসতে পারে। এই ঘটনা ঘটতে পারে ২১৭৫ থেকে ২১৯৯ সালের মধ্যে । বেনুর পক্ষে পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনা ২৭০০ ভাগের ১ ভাগ , অর্থাৎ শতকরা হিসেবে ০.০৩৭% ( Bennu that will come within about 4.6 million miles (7.5 million kilometers) of Earth’s orbit and are classified as potentially hazardous objects. Between the years 2175 and 2199, the chance that Bennu will impact Earth is only 1-in-2,700)
পৃথিবীর আশেপাশে প্রচুর গ্রহাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে এরা পৃথিবীর খুব নিকটেই চলে আসে। এসকল গ্রহাণু কিংবা Near Earth Object (NEO) নিয়মিতভাবে মনিটর করা হয়। একটু গুগল করলেই সহজে এদের খোজ খবর পাওয়া যায়। আপনি নিজেই এদের ট্র্যাক করতে পারবেন নাসার ওয়েবসাইটের এই কিংবা এই পেজগুলো ব্যবহার করে।
যেমন- এই রিপোর্ট যখন লেখা হচ্ছে (১৩ই জুলাই) তখনই পৃথিবীর বেশ কাছ দিয়ে 2019ATC নামের একটি গ্রহাণু চলে যাচ্ছে , মাত্র ১৬ লক্ষ কিলোমিটার দূর দিয়ে ।
এই দুইটা গ্রহাণুই বেনু (৭৫ লাখ কিলোমিটার) এর চেয়ে অনেক কাছ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এদেরকে কেউ বিপজ্জনক বলছে না কিংবা এদের নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন হচ্ছে না। কারন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এদের পক্ষে পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। অর্থাৎ , পৃথিবী থেকে চাঁদ যতদূরে রয়েছে , তার চেয়েও চার গুন বেশি দূর দিয়ে 2019 AKT এবং 2019 ATC গ্রহাণু দুটো চলে যাচ্ছে।
একইভাবে, 101955 Bennu নামক গ্রহাণুটার পৃহিবী থেকে নিকটতম দূরত্ব হবে ৭.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার অর্থাৎ ৭৫ লাখ কিলোমিটার। তার মানে পৃথিবী থেকে চাঁদ যত দূরে রয়েছে, তার চেয়ে ১৯ গুণ বেশি দূর দিয়ে বেনু চলে যাওয়ার কথা।
তবে , ২১৭৫ সালে বা তার আগে কোনো কারণে গতিপথ পরিবর্তন করলে বেনু পৃথিবীকে আঘাত করতে পারে বিধায় বিজ্ঞানীরা একে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকায় রেখেছেন।
আকাশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ গ্রহাণু আরো রয়েছে। নাসার অঙ্গ সঙ্গঠন , Center for Near Earth Object Studies ( cneos ) এর ওয়েবসাইটে এমন সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ গ্রহাণুর একটি তালিকা পাওয়া যাচ্ছে।
এখানে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরেই ২০২২ সালেই 2009 JF1 নামের গ্রহাণু আঘাত করতে পারে পৃথিবীকে। যদিও সম্ভাবনা খুবই কম, 2.6e-4 অর্থাৎ, ৩৮০০ ভাগের এক ভাগ। (101955 Bennu এর আঘাত করার সম্ভাবণা 3.7e-4 অর্থাৎ ২৭০০ ভাগের এক ভাগ )
সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় গ্রহাণু হল 2017 WT28 , যার পক্ষে ২০৮৩ সালে পৃথিবীতে আঘাত করার সম্ভাবনা 1.1e-2 অর্থাৎ ১.১% ,কিংবা ১০০ ভাগের মধ্যে ১ ভাগ।
এ সকল বেশি সম্ভাবনাময় গ্রহাণুকেও ‘নিশ্চিত পৃথিবীতে আঘাত করবে’ বলা যাচ্ছে না। সেখানে ২১৭৫ সালের একটি কম সম্ভাবনাময় গ্রহাণুর খবর নিয়ে ‘’ব্রেকিং নিউজ : মহাবিপদে পৃথিবী, মারা যাবে লাখ লাখ মানুষ’’ ধরনের সংবাদ করলে নিশ্চিতভাবেই সেটা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াবে বলে ফ্যাক্টওয়াচ মনে করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?