অন্যান্য অনেক পেশার মত আইনজীবীদেরও বিশেষ এক ধরণের পেশাগত পোশাক রয়েছে। সাদা শার্টের উপর কালো রঙ এর কোট বা শেরওয়ানি সদৃশ একটি পোশাক এবং সাদা শার্ট। কিন্তু কেন এই কালো রঙ এর কোট বা শেরওয়ানি? সম্প্রতি কিছু ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, কালো এই কোট পরার কারণ শৃঙ্খলা এবং আত্মবিশ্বাস। আবার এমনও অনেক দাবি আছে যেখানে বলা হচ্ছে, এমন পোশাকের অর্থ হলো “আইন অন্ধ”, কিংবা কালো গাউন পরিধানের কারণে নিজের পরিচয় গোপন রাখা যায় ইত্যাদি। আসলেই কি তাই? চলুন এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক আজকের এই ফ্যাক্ট-ফাইলে।
আইনজীবীরা কি এমন পোশাক পরতে বাধ্য? অথবা এটি কি কোনো আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? না কি শুধুই একটি রীতি?
এমন প্রশ্নের বিপরীতে অনুসন্ধান করা হলে “লয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ” এ ৩১ মে, ২০২০ এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাাডভোকেট মোহাম্মদ শাহজাহানের লেখা এই নিবন্ধ থেকে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক বিধিমালা দিয়ে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে আইনজীবীরা কোন ধরণের পেশাগত পোশাক পরবেন। শুরুতে ‘দ্য সুপ্রিম কর্ট অব বাংলাদেশ (এপিলিয়েট ডিভিশন) রুলস, ১৯৮৮’ যেটি ২০০৮ এ সংশোধিত হয়েছে, এর ৪ নং অর্ডারের ৩৮ ন্ং বিধিতে বলা হচ্ছে, “The dress prescribed for Advocates is a short coat or Sherwani of black material, white shirt with turn down collar and white bands: in the summer, white trousers, and in the winter, trousers of materials in deeper shades of grey. The Advocate shall wear a short black gown in Court, unless the Court directs otherwise. The dress for Senior Advocates shall be similar, with the following additional requirement, viz., they shall wear gown as prescribed for Banisters appearing before the High Court in London.”।
অর্থাৎ, এখানে এডভোকেটদের পোশাক হিসেবে, একটি কালো রঙ এর শর্ট কোট অথবা শেরওয়ানির কথা বলা হচ্ছে। এর সাথে সাদা শার্ট এবং একটি সাদা ব্যান্ড (নেক ব্যান্ড। গ্রীষ্মকালের জন্য প্যান্ট হবে সাদা আর শীতকালে গাড় ধূসর রং এর প্যান্টের কথা বলা হয়েছে।
একইভাবে ‘দ্য সুপ্রিমকোর্ট অব বাংলাদেশ (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলস, ১৯৭৩’ এ পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা ড্রেসকোডের বিষয়ে বলা হচ্ছে:
“2. Dress of Judges and Advocates-
The dress of Judges shall be as follows:
White shirt with turned up white collar and white bands:
Judge’s coat without lapel, fully buttoned and full sleeved:
Trousers of black or white or light coloured material:
Judge’s gown
The dress of Advocates shall be as follows:
(a) a coat or sherwani of black material:
(b) white shirt with turned up white collar and white bands:
(c) trousers of black or white or light coloured materials:
(d) Advocate’s gown (half sleeved of black colour).
Female Advocates may wear white or light cloured shari or shalowar kamiz of white colour materials. All female Advocates shall wear black coat. Female Advocates using shari or shalowar kamiz shall also wear white collar with white band. A female Advocate shall wear the Advocate’s gown specified above.
Advocates enrolled with the Appellate Division may wear the dress prescribed for the Appellate Division”
মূলত, সবগুলো বিধি-বিধানেই কালো কোটের কথাই বলা হচ্ছে। এর মানে বাংলাদেশের আইন সংক্রান্ত একাধিক নীতিমালা অনুযায়ী এডভোকেটদের কালো রঙ এর একটি কোট পরতে হয়। অর্থাৎ, এটি শুধুমাত্র একটি রীতি নয় বরং আইনের বিভিন্ন বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি নির্দেশিকা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোটের বিষয়টি এলো কোথা থেকে?
বাংলাদেশের বিচারবিভাগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজকের এই বিচারবিভাগ প্রায় হাজার বছরের বিবর্তনের ফসল। বিচারবিভাগের এই ইতিহাসকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল দিয়ে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে, হিন্দু পিরিয়ড, মুসলিম পিরিয়ড, ব্রিটিশ শাসনামল এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কাল। এর মানে দেশে যত আইন এবং বিধিমালা রয়েছে এর প্রায় সবকিছুই এই সময়কাল দ্বারাই প্রভাবিত। অর্থ্যাৎ, ধারণা করা যায় কালো কোট বা আইনজীবীদের এমন পোশাকের পিছনের মূল কারণও এর মধ্যেই রয়েছে।
নিউজবাংলা ২৪ প্রকাশিত “উকিলেরা কালো কোট পরেন কেন?” শিরোনামের এই নিবন্ধ থেকে জানা যায়, উকিলদের এমন পোশাকের পিছনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশক শাসনকাল দায়ী। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের উদ্ধৃতিতে বলা হয়, “ব্রিটিশরা তাদের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের জন্য শোক প্রকাশের যে পোশাক পরেছিল, শত শত বছর ধরে সেই পোশাকই আইনজীবীরা ব্যবহার করে আসছেন। সেই শোক যেন আর শেষই হচ্ছে না। সময়ের প্রয়োজনে অবশ্যই এটা পরিবর্তন হওয়া উচিত।“
প্রায় একই দাবি বিবিসি প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনেও। সেখানে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে দাবি করে বলা হয়, “১৬৮৫ সালে ইংল্যান্ডে রাজা দ্বিতীয় চার্লস মারা যাবার পর শোকের প্রকাশের জন্য আদালতে আইনজীবী এবং বিচারপতিরা কালো কোট ও গাউন পরা শুরু করেন। সেই থেকে গত প্রায় ৩৩৫ বছর যাবৎ কালো কোট পরিধান করার রেওয়াজ চালু আছে। শত-শত বছর যাবৎ এই পোশাক কেন প্রচলিত আছে কিংবা এক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আসেনি কেন সে নিয়ে পরিষ্কার কোন ধারণা আইন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যাওয়া যায়নি”।
গ্লোবাল জার্নাল অব হিউম্যান সোশ্যাল সাইন্সেস প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ফ্রেড ফিলিপস এর “দ্য ইভোলভিং লিগ্যাল প্রফেশন ইন দ্য কমনওয়েলথ, ১৯৭৮” বইয়ের ১১৫ এবং ১১৬ পৃষ্ঠার বরাতে কালো এই রোব বা শেরওয়ানির পিছনে প্রচলিত তিনটি “গল্প” খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমটির সাথে উপরোক্ত বিবিসি এবং নিউজবাংলা প্রকাশিত তথ্যের মিল পাওয়া যায়। যেখানে বলা হচ্ছে, এই কোটটি নেয়া হয়েছে ১৬৮৫ সালে, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় দাবিটিতে বলা হচ্ছে, ১৬৯৪ সালে রাণী দ্বিতীয় মেরির শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের সময় বিচারকেরা এই পোশাকটি পরেন। রাণীর দাফনের আরোও কয়েকবছর পর্যন্ত এই শোক স্থায়ী হয়েছিল। এরপর থেকেই ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থায় এই ড্রেস কোড ঠাঁই পায়। আর তৃতীয় দাবিতে বলা হচ্ছে, রাণী অ্যানির স্মৃতিতেও এই একই পোশাকে শোক প্রকাশ করা হয়েছিলো। এভাবেই ধীরে ধীরে কালো আলখাল্লা পরার রীতি শুরুতে ব্রিটেনে এবং পরবর্তীতে এর আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এখনো চালু রয়েছে।
তবে আইনজীবীদের নির্দিষ্ট ড্রেস কোডের প্রমাণ পাওয়া যায় তারও আগে। মূলত ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড (১৩২৭-১৩৭৭) এর শাসনামল থেকেই বিচারকদের রয়েল কোর্টে অংশগ্রহণ করার জন্য নির্দিষ্ট পোশাকের বিধান শুরু হয়।
অর্থ্যাৎ, শতভাগ নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এটি বুঝা যাচ্ছে মূলত ব্রিটিশ শাসনের কোনো এক সময় থেকেই আইনজীবীদের এই কালো কোট পরার বিধান শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তাদের অধীনে থাকা কলোনিগুলোতেও এই নিয়মেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
কেন এই কালো রঙ?
এখানে কালো রঙ আসলে কি বুঝায় এ সংক্রান্ত বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা আইনের ধারাগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে পাওয়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী এখানে কালো রঙ সাধারণত শোক, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা এবং নিজেকে কোনো কিছুর প্রতি নত করাকে বুঝায়। এক্ষেত্রে আইনের প্রতি নিজেকে নত করাকে বুঝাচ্ছে। এছাড়া অনেকেই এর সাথে আইন অন্ধ এই বিষয়টিরও একটি যোগাযোগ আছে বলে ব্যাখ্যা করেছেন। বেশিরভাগ দেশের আইনজীবীদের পোশাকে কালো, সাদা এবং লাল রঙ এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। এরমধ্যে লাল রঙ সাহস এবং ত্যাগ বুঝায়, এছাড়া সাদা মূলত বিশুদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে।
এই পোশাক নিয়ে আইনজীবীদের মতামত?
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক আইনজীবীরা এই কালো কোট বা শেরওয়ানিকে নিজেদের দেশের আবহাওয়ার জন্য ঠিক মনে করেন না। তারা মনে করেন যেহেতু সবজায়গায় এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবস্থা নেই তাই গরমকালে এই পোশাক অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। সর্বশেষ করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের আদালতগুলোতে ১২ আগস্ট ২০২০ থেকে কালো কোট ও গাউন ছাড়াই মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পান বিচারক এবং আইনজীবীরা। এরপর পুনরায় একই বছরের নভেম্বর থেকে কালো কোটে ফেরেন সবাই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসলে সেটি আবার শিথিল করা হলেও অক্টোবর ২০২১ থেকে আবার সেটি তুলে নেয়া হয়।
এ বিষয়ে নিউজবাংলা ২৪ এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কালো এই কোটের সাথে ন্যায় বিচারের আলাদা কোনো সম্পর্ক নেই তাই দেশের আবহাওয়া এবং পরিবেশ বিবেচনায় এর পরিবর্তন হতে পারে। তবে এ বিষয়ে আইনজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে বলে জানা যায়। অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের মতে, একটি স্বাধীন দেশে আদালতের পোশাক ঔপনিবেশিক আমলের রীতি দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়। আবার অনেক আইনজীবী মনে করছেন এমন পোশাকের প্রয়োজন আছে। এর মাধ্যমে আইনজীবীদের আলাদা করে চিনতে সুবিধা হয় বলে মনে করেন তারা।
উল্লেখ্য, ভারতে গরমকালে আইনজীবীদের এমন পোশাকের বিপরীতে এই একটি পিটশন দাখিল করা হয়। তবে পরবর্তীতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেটি গ্রহণ করেনি। সেখানেও আইনজীবীদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
মোটাদাগে যেকোনো ড্রেসকোডই এক ধরণের শৃঙ্খলা এবং পেশাগত চিহ্ন ধারণ করে। তবে আইনজীবীদের কালো কোটের মানে হিসেবে শুধু শৃঙ্খলা এবং আত্মবিশ্বাস বলাটা অতি সরলীকরণ করা হয়। শৃঙ্খলা কিংবা আত্মবিশ্বাস থেকে নয় বরং এই কোটের জন্ম শোক, ক্ষমতা এবং ঔপনৈবেশিক শাসন থেকে। অনেকে এর সাথে আইন অন্ধ কিংবা এর মাধ্যমে নিজের ব্যক্তি পরিচয় গোপন করাকেও যুক্ত করে থাকেন। তবে এই কালো কোটের ইতিহাস ঘাঁটলে ব্রিটিশ শাসনামলের ক্ষমতাধরদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের ঘটনাগুলোই সামনে আসে।