আমেরিকার বোস্টনে এক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর শরীরে বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজে নিজেই সাপের বিষ তৈরি হয়েছিল, এবং সেই বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছিল-এমন একটা গুজব দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে প্রচারিত হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনাটা সত্য নয়। বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশেও এই গুজবটি প্রচারিত হয়েছে। সেসব দেশের ফ্যাক্টচেকাররাও জানিয়েছেন, এমন কোনো ঘটনার হদিস পাওয়া যায় নি।
গুজবের উৎস
গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন সময়ে অনলাইনে এই গুজবটি দেখা গিয়েছে । যেমন- ১৩ই মে,২০২২ তারিখে মোটিভেশন নামক পেজে এই পোস্ট দেখা যায়।
এখানে বলা হয়েছে, আমেরিকার বোস্টনে ১৯৮৬ সালে একটি অদ্ভুত পরীক্ষা করা হয়৷ এক ফাঁসির আসামীকে ফাঁসির সাজা শোনানো হলো৷ কতিপয় বিজ্ঞানী সে আসামীর উপর একটি পরীক্ষা করার প্রস্তাব করলেন। কয়েদীকে শোনানো হলো ফাঁসির বদলে তোমাকে বিষাক্ত কোবরা সাপ দংশন করিয়ে হত্যা করা হবে।
কয়েদীকে চেয়ারে বসিয়ে তার হাত-পা বেঁধে দেয়া হলো, তারপর তার চোখে পট্টি বেঁধে বিষাক্ত কোবরা সাপ না এনে তার বদলে দুটি সেফ্টি পিন ফুটানো হলো। ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কয়েদির মৃত্যু হলো ৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা গেল সাপের বিষ রয়েছে তার শরীরের মধ্যে। প্রশ্ন হলো এই বিষ কোথা থেকে এলো, যা ঐ কয়েদীর প্রাণ কেড়ে নিল?
বলা হয়, সেই বিষ তার নিজের শরীর থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল। আমাদের সংকল্প থেকে positive এবং negative এনার্জির সৃষ্টি হয়। আর সে এনার্জি আমাদের শরীরে হরমোন উৎপাদন করে ৷ ৭৫% রোগের মূল কারণ হলো আমাদের negative চিন্তাধারা। মানুষ নিজের চিন্তাধারা থেকে ভস্মাসূর হয়ে নিজ প্রজাতিকে বিনাশ করছে।
আমেরিকার বোস্টন শহরটি ম্যাসাচুসেটস ( Massachusetts) রাজ্যের রাজধানী । আর এই ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে ১৯৮৪ সাল থেকে মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ । গুরুতর অপরাধীদের অতি দীর্ঘ মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়, কিন্তু মৃত্যদন্ড দেওয়া হয়না।
ম্যাসাচুসেটস এ সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৯ই মে তারিখে । সেদিন Phillip Bellino এবং Edward Gertson নামক দুজন কয়েদীকে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে , শরীরে বিদ্যুতের শক দেওয়ার মাধ্যমে মৃত্যু কার্যকর করা হয়েছিল।
ভাইরাল পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, ১৯৮৬ সালে আমেরিকার বোস্টনে এক আসামীকে ফাঁসির সাজা শোনানো হলো৷ এখানে স্পষ্টতই দুইটা ভুল তথ্য দেখা যাচ্ছে ।
১। ১৯৮৬ সালে বোস্টনে কোনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না। তাই কাউকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়ার কথা নয়।
২। ফাঁসি নয়, বোস্টনে মৃত্যুদণ্ডের প্রচলিত পদ্ধতি ছিল ইলেক্ট্রিক শক। ১৯৪৭ সালে বোস্টনের সর্বশেষ মৃত্যুদণ্ডে সেটাই ব্যবহার করা হয়েছিল। কাজেই ১৯৮৬ সালে বোস্টনে কাউকে ফাঁসির সাজা অবান্তর।
এছাড়া, প্রচলিত পথে একজনকে সাজা না দিয়ে যদি তার উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ভিন্ন পথে সাজা কার্যকর করতে হয়, তাহলে আইনে ব্যাপক রদবদলের দরকার হত। ম্যাসাচুসেটস কিংবা আমেরিকার আইনে পরিবর্তন আনতে হত। সংসদে আলোচনা কিংবা আদালতে মামলারও দরকার হত। এসব বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক আলোড়ন পড়ে যেত। কিন্তু তেমন কিছুই যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে না, কাজেই ধরে নেওয়া যায়, এমন কিছু ঘটেনি।
এছাড়া, একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর উপরে , বিশেষ করে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর উপরে এমন কোনো সাইকোলজিকাল টেস্ট করা হলে সেটা নিয়ে একাডেমিক পর্যায়ে অনেক গবেষণা পাওয়া যেত। যেমন -১৯৭১ সালের Stanford prison experiment খুবই আলোচিত একটি গবেষণা যেখানে কয়েকজন ভলান্টিয়ারকে ১৪ দিনের জন্য একটি জেলখানায় আটক করে তাদের মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের বোস্টনের কথিত পরিক্ষার কোন গবেষণাপত্র,খবর,সাক্ষাতকার,ছবি বা কিছুই পাওয়া যায় না । কাজেই ধরে নেয়া যায়, এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।
ভাইরাল পোস্টের সাথে এই ছবিটাও শেয়ার করা হচ্ছে। এখানে দেখা যায় জনৈক ব্যক্তিকে একটি চেয়ারে রেখে মাথায় এবং হাতে বৈদ্যুতিক তার বাঁধা হচ্ছে । আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে, একজন কয়েদীকে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে শক দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তবে এই ছবিটি বাস্তব কোনো মৃত্যুদণ্ডের ছবি নয়। ১৯১৬ সালে মুক্তি পাওয়া ডেনমার্ক এর চলচ্চিত্র Danserindens kærlighedsdrøm থেকে এই দৃশ্যটি নেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদন্ডের প্রতীকী ছবি হিসেবেও এটা খুবই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
শুধুমাত্র বাংলা ভাষা নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ভাষাতেও বিভিন্ন সময়ে এই গুজব ভাইরাল হয়েছে। অন্যান্য দেশের ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাও যাচাই বাছাই করে এই গল্পকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে ইন্ডিয়া টুডে , স্টেক এক্সচেঞ্জ , স্নোপস ইত্যাদি।
এমনকি এসব গল্প ভাষা বা দেশান্তরে গিয়ে পরিবর্তিত ও হয়েছে। আমেরিকান কয়েদীর জায়গায় রাশিয়ান কয়েদীর গুজব ও শোনা যায় । সাপের কামড় এবং পিন ফোটানোর বদলে তরবারীর শিরোচ্ছেদ এবং ঠান্ডা ভেজা তোয়ালে দিয়ে স্পর্শ করার গুজব ও প্রচলিত। তবে এসবের কোনো গুজবের ক্ষেত্রেই কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তাই ফ্যাক্টওয়াচ বাংলা ভাষায় প্রচারিত এই গুজবটিকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?