ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জনের ইসলাম গ্রহণ – পুরোনো খবর এবং বিভ্রান্তিকর

13
ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জনের ইসলাম গ্রহণ – পুরোনো খবর এবং বিভ্রান্তিকর ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জনের ইসলাম গ্রহণ – পুরোনো খবর এবং বিভ্রান্তিকর

Published on: [post_published]

সম্প্রতি “ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জন ইসলাম গ্রহণ” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করেছে ‘arabianbarta.com’ এবং ‘jeneniin.com’সহ একাধিক অনলাইন পোর্টাল যা পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যায়। মূলত এটি ৭ বছর আগের একটি সংবাদ যা সাধারণ পাঠকের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে — এমন তথ্যের কোন সূত্র প্রতিবেদনগুলো হাজির করে নি। এমনকি ফ্যাক্টওয়াচ টিম যাচাই করেও উক্ত খবরের শিরোনাম এবং বিস্তারিত অংশে করা দাবিগুলোর পক্ষে নির্ভরযোগ্য কোন প্রমাণ খুঁজে পায় নি।

ফেসবুকে ভাইরাল “ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জন ইসলাম গ্রহণ” শীর্ষক শিরোনামে পোস্টগুলো দেখুন এখানে এখানে এখানে এখানে এখানে

 

 

 

 

 

 

 

ফ্যাক্টওয়াচ গবেষণা চালিয়ে দেখে, উক্ত ভাইরাল খবরটি প্রায় ৭ বছর আগের। ২২ জুলাই ২০১৪ তারিখে “মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে ব্রাজিলে” শিরোনামে খবরটি প্রথম প্রকাশ করে অনলাইন পোর্টাল thesunrisetoday.com। সেখানে দাবি করা হয় ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে মাসে গড়ে ৬ জন মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন এমন তথ্য প্রতিবেদক সাওপাওলোর ব্রাইস মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ রডরিগোর কাছ থেকে জেনেছেন। কিন্তু দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে ৬ জন ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন এমন কোন দাবি সেখানে ছিল না। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে অর্থাৎ প্রায় ২ বছর আগে বাংলাদেশের পোর্টাল ‘Jagonews24.com’ একই খবর প্রকাশ করেছিল।

 

তবে ২০১৯ সালে এসে ‘Jagonews24.com’ বিভ্রান্তিকর শিরোনামযোগে খবরটি পুনঃপ্রকাশ করেছে যা অন্যান্য অনলাইন পোর্টালের বরাত দিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এ সকল প্রতিবেদনের শিরোনাম পড়ে সাধারণ পাঠকের কাছে মনে হতে পারে ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জন ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করছেন। কিন্তু খবরের বিস্তারিত অংশের কোথাও দাবির পক্ষে নেই কোন তথ্য-উপাত্ত বা সূত্র। ধারণা করা হচ্ছে খবরটির জনপ্রিয়তার দিকে লক্ষ্য করেই মূল দাবির ‘মাস’-এর জায়গায় ‘দিন’ এবং ‘সাও পাওলো’ শহরের পরিবর্তে ‘ব্রাজিল’ লিখে শিরোনামকে অতিরঞ্জিত করেছেন প্রতিবেদক।

 

অন্যদিকে, প্রতিবেদনের বিস্তারিত অংশে বলা হয়েছে, “২০ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মসজিদ ও মুসলমানের সংখ্যাও। বর্তমানে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫-৬ শতাংশ।” আমরা এখানেও তথ্যগত বেশ কিছু অসঙ্গতি লক্ষ করেছি। প্রথমত, দাবি অনুযায়ী দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা ১৭ লাখ হলে তা মোট জনসংখ্যার ৫-৬ শতাংশ নয়, বরং ১ শতাংশেরও কম। দ্বিতীয়ত, ‘World Population Review ২০২১” এর জনসংখ্যা জরিপ তথ্য বলছে ব্রাজিলে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ লাখ যা মোট জনসংখ্যার ০.৩৬ শতাংশ।

 

Pew Research Center এর ২০১১ সালের ‘Muslim Population by Country’ জরিপটি বলছে ভিন্ন কথা। তাদের তথ্যমতে ১৯৯০ সালে ব্রাজিলের মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার যা ২০১০-এ এসে হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার। একই জরিপে ধারণা করা হয়েছে ২০৩০ সালে দেশটির মোট মুসলিম জনসংখ্যা ২ লাখ ২৭ হাজারে পৌঁছতে পারে।

 

কেবল ‘Federation of Muslim Associations of Brazil’ দাবি করে সংখ্যাটি ১৫ লাখের কাছাকাছি। বিস্তারিত জানতে Refworld এর ‘2013 Report on International Religious Freedom – Brazil’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে। আমরা ব্রাজিলের মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে তথ্যগত পার্থক্য দেখলেও এ কথা প্রমাণ করেছি যে, তা মোট জনসংখ্যার ৫-৬ শতাংশ নয়।

 

Harvard Divinity School-এর ‘Islam in Brazil’ টীকাপুঞ্জে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ লাখ  ইসলাম ধর্মানুসারী যা লাতিন আমেরিকার সর্ববৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী। এদের বেশিরভাগ মূলত আরব বংশোদ্ভূত এবং সংখ্যায় কম হলেও ক্রমবর্ধমান ধর্মান্তরিত মুসলিম। ব্রাজিলিয়ান মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিয়া ও সুন্নি উভয়ই আছে।

 

উল্লেখ্য, ব্রাজিলে ইসলামের আগমন আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের সূচনালগ্ন থেকেই যখন দেশটিতে আফ্রিকান ক্রীতদাস শ্রম আমদানি করা হয়েছিল। তবে সমসাময়িক মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলো গঠিত হয় ১৯শ-২০শ শতাব্দীর সিরিয়ান এবং লেবানিয়ান অভিবাসীদের আগমনের হাত ধরে। ১৮৩৫ সালে আফ্রো-ব্রাজিলীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মালা বিদ্রোহের পর পুরো ব্রাজিল জুড়ে প্রায় ১১ মিলিয়ন সিরিয়ান এবং লেবানিয়ানদের অভিবাসন ঘটে। তবে প্রথম দিকে তাদের বেশিরভাগই ছিলো খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। বর্তমানে ব্রাজিলে মুসলমানদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি আদমশুমারী এবং মুসলিম সংগঠনগুলোর দাবির মধ্যে বিস্তর অমিল থাকলেও অ-আরব নাগরিকদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কোন বিতর্ক নেই বললেই চলে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত “Islam in Brazil or the Islam of Brazil?” শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রের বরাতে জানা যায় যে ব্রাজিলে প্রায় ১০,০০০ ধর্মান্তরিত মুসলিম বাস করছেন যদিও তা দেশটির খ্রিস্ট ধর্মের যাজকদের সংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।

 

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে ব্রাজিলে ধর্মান্তরিত মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সাথে বিস্তৃত হচ্ছে লাতিন আমেরিকার সর্ববৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী। কিন্তু এ বৃদ্ধির হার নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য বা জরিপ আমরা খুঁজে পাই নি। পক্ষান্তরে, একাধিক অনলাইন পোর্টাল ব্রাজিলে প্রতিদিন গড়ে ৬ জন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে এমন অনুমাননির্ভর তথ্য দিয়ে সাধারণ পাঠকের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। ফ্যাক্টওয়াচ এহেন সংবাদের সূত্র অনুসন্ধান করে জানতে পারে সেটি ৭ বছর আগের একটি খবর এবং এই ৭ বছর পরেও নতুন কোন তথ্য সেখানে সন্নিবেশিত করা হয় নি। তাই উক্ত ভাইরাল খবরটিকে কোন সাম্প্রতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না।

 

তথ্যসূত্র

Muslim Population By Country 2021

Pew Research Center: Muslim Population by Country

2013 Report on International Religious Freedom – Brazil

Harvard Divinity School- Islam in Brazil

Islam in Brazil or the Islam of Brazil?

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

No Factcheck schema data available.