৪০ হাজার লোক ভ্যাক্সিনের ২ ডোজ নিয়েও করোনা আক্রান্ত — এমন একটা সংবাদ বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, এটা ভারতের কেরালার সংবাদ। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তার উপর, কতজনের মধ্যে এই ৪০,০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সেটাও পরিষ্কার করে না বলায় খবরটি আতঙ্ক তৈরি করছে সামাজিক মাধ্যমে।
গুজবের উৎস
১১ই আগস্ট সন্ধ্যা ৬ টা ৬ মিনিটে ‘HSC’21 অটোপাস চাই’ নামক ফেসবুক গ্রুপ থেকে এই গুজব প্রথম দেখা যায়। গ্রুপের মডারেটর, Mîthílà Ãktēr Zárá Kháñ এই পোস্টে লেখেন, টিকার দুই ডোজ নিয়েও করোনায় আক্রান্ত ৪০ হাজার। (Source : The Daily Campus) HSC’21 অটোপাশ চাই
দি ডেইলি ক্যাম্পাস এর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে দেখা গেল, ১১ই আগস্ট বিকেল ৫ টা ৭ মিনিটে ‘টিকার দুই ডোজ নিয়েও করোনায় আক্রান্ত ৪০ হাজার’ শীর্ষক একটি খবর শেয়ার করা হইয়েছিল। দি ডেইলি ক্যাম্পাস এর ওয়েবসাইটে মূল খবরে গিয়ে দেখা গেল, এটা ভারতের কেরালায় দুই ডোজ নিয়েও ৪০ হাজার নাগরিকের করোনা আক্রান্তের খবর দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু , ভারতের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে ,HSC’21 অটোপাশ চাই গ্রুপে এটাকে এমনভাবে ছড়ানো হয় যেন মনে হয় এটা বাংলাদেশের খবর। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অন্যান্য ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপেও এভাবেই খবরটি ভাইরাল হতে থাকে।
যেমন- ১১ই আগস্ট সন্ধ্যা ৬ টা ১৩ মিনিটে ‘আবিদ’ নামক পেজ থেকেও এই গুজব ছড়ানো হয়। এই পোস্টে দি ডেইলি ক্যাম্পাস বা কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই এক লাইনের পোস্টে লেখা হয়, টিকার দুই ডোজ নিয়ে করোনায় আক্রান্ত ৪০ হাজার।
আবিদ এর পেজের ইনফো সেকশনে তাকে ‘এডুকেশনাল কনসাল্টান্ট’ বা শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এবং এই পেজ থেকে নিয়মিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত খবরাখবর দেওয়া হয় বিধায় সাধারণ ব্যবহারকারীরা এটিকে বাংলাদেশের খবর হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। এমন স্ট্যাটাসের কারণে অনেকে টিকা নিয়ে আতংক প্রকাশ করেন মন্তব্যের ঘরে। কয়েকজনকে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা জানাতেও দেখা যায়।
৬ টা ৩৫ মিনিটে শিক্ষা বার্তা নামক পেজ থেকে এই গুজবটা ছড়ানো হয়।
SSC & HSC – 2021/22 assignment & solution নামক গ্রুপে সন্ধ্যা ৬ টা ৩৯ মিনিটে এই গুজবটা দেখা যায়।
HSC’21 অটোপাস চাই নামক গ্রুপ থেকে পুনরায় সন্ধ্যা ৭ টা ৩৪ মিনিটে এই গুজব ছড়ানো হয়।
বাংলাদেশ শিক্ষাবার্তা পেজ থেকে রাত ৮ টা ১৬ মিনিটে একই স্ট্যাটাস দিতে দেখা যায়।
এই সবগুলো পেজ/গ্রুপই বাংলাদেশের , এবং এদের অধিকাংশ পাঠক-অনুসারীই বাংলাদেশী। অনেকের পেজের নামের সাথেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা রয়েছে ( যেমন- বাংলাদেশ শিক্ষাবার্তা) । সঙ্গত কারণেই ফেসবুক-ব্যবহারকারীরা এই গুজবটিকে বাংলাদেশের সংবাদ ভেবে নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
১১ই আগস্ট বিকাল থেকে ভারতের সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হতে থাকে যে , টিকার ২ ডোজ নিয়েও কেরালায় ৪০ হাজার কোভিড পজিটিভ হয়েছেন। যেমন, আনন্দবাজার পত্রিকার ওয়েবসাইটে সন্ধ্যা ৬ টা ২ মিনিটে এই খবরটা প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল- Coronavirus in Kerala: ডেল্টা দায়ী? টিকা নেওয়ার পরও কেরলে কোভিডে আক্রান্ত ৪০ হাজার, বাড়ছে উদ্বেগ।
কাছাকাছি সময়ে একই ধরনের সংবাদ পরিবেশন করে এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টুডে, সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। বাংলাদেশেও যায়যায়দিন , জনকন্ঠ, সময়ের কন্ঠস্বর সহ কয়েকটি মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ভারতের কেরালার এই খবরটি দেখা যায়।
তবে লক্ষনীয়, বাংলাদেশের মূলধারার এসব সংবাদমাধ্যমে শিরোনামেই ‘ভারত’ বা ‘কেরালা’ কথাটি উল্লেখ করেছে। ফলে দি ডেইলি ক্যাম্পাস এর খবরের মত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়নি।
এসব খবরে বলা হয়, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় করোনাভাইরাসের টিকার উভয় ডোজ সম্পূর্ণ করার পরও ৪০ হাজারের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে পাঠানমথিট্টা জেলায় । পুনরায়সংক্রমণেরজন্যদায়ীডেল্টাভ্যারিয়েন্টনাকি অন্য ভ্যারিয়েন্ট, তাএখনওজানাযায়নি। এসব আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্সিং এর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
অর্থাৎ, এসব খবর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ৪০ হাজার সংক্রমণের এই খবরটি কেবলমাত্র ভারতের একটি রাজ্যের (কেরালার) খবর। বাংলাদেশের সাথে এর কোনো সংযোগ নেই।
২ ডোজ টিকা নেওয়ার পরেও কি কোভিড সংক্রমণ ঘটতে পারে?
হ্যাঁ, ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো টিকাই ১০০% সুরক্ষা দেয় না। একেক টিকা একেক পরিমানে সুরক্ষা দিতে পারে, তবে কিছুটা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার ২ সপ্তাহ পরে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে , দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরেও কোভিড পজিটিভ হওয়ার ঘটনা ঘটে। একে মেডিকেলের পরিভাষায় ‘Breakthrough Infection’ বা ব্রেকথ্রু সংক্রমণ বলা হয়।
কোন ভ্যাক্সিন কত পার্সেন্ট ক্ষেত্রে সুরক্ষা দিতে পারে, সেটা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট এর বিরুদ্ধে এসব ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা যাচাই করা হয়েছে ।
উইকিপিডিয়ায় বিভিন্ন তথ্যসূত্র সহযোগে বাজারে এই মুহুর্তে মজুদ থাকা কোভিড ভ্যাক্সিনগুলোর কার্যকারিতার একটা তুলনামূলক পর্যালোচনা দেখিয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, অক্সফোর্ড এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা ৮১% , ফাইজার-বায়োএনটেক এর টিকার কার্যকারিতা ৯৫%, মডার্নার কার্যকারিতা ৯৪%, সিনোফার্ম এর কার্যকারিতা ৭৮% ইত্যাদি।
.
বিশ্বখ্যাত ,মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট এবং ইয়েল মেডিসিন এও বিভিন্ন ভ্যাক্সিন এর কার্যকারিতা নিয়ে তুলনামূলক পর্যালোচনা দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটেও সকল ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতার তথ্য পাওয়া যায়।
২ ডোজ টিকা নেওয়ার পরে কত শতাংশ Breakthrough Infection এর ঘটনা ঘটছে ?
দি হিন্দু বিজনেস লাইনের গত পহেলা আগস্টের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের কেরালা রাজ্যে ৬০ লাখ ৪৯ হাজার জনগণকে কোভিডের দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছেন ৪০ হাজার।
শতকরা হিসাব করলে দেখা যায় , এটা ০.৬৬% । অর্থাৎ ১ শতাংশের ও কম। দুই ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে প্রতি ১৫০ জনের মাঝে ১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
অর্থাৎ, ৪০ হাজার সংখ্যাটা শুনতে খুব বড় মনে হলেও, বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা হার হিসাব করলে দেখা যায় , সংখ্যাটা অত বড় নয়।
আমেরিকায় এমন ব্রেকথ্রু সংক্রমণের হার আরো কম। গত ১০ই আগস্ট আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি এর এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত ১৬ কোটি ৪২ লাখ আমেরিকান নাগরিককে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার ৬৮২ জন ব্রেকথ্রু সংক্রমণ এর শিকার হয়েছেন। শতকরা হিসাবে ০.০৭৬ % , অর্থাৎ প্রতি ১৩০৭ জন দুই ডোজ টিকা গ্রহণকারীর মধ্যে এক জন ব্রেক থ্রু সংক্রমণের শিকার হতে পারেন।
বাংলাদেশে এমন ব্রেকথ্রু সংক্রমণের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। তবে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার পাতায় ব্রেক থ্রু সংক্রমণ এর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমন কিছু খবর দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে , এখানে, এখানে।
বাংলাদেশে গত ৭ই ফেব্রুয়ারি কোভিড এর প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হয় এবং ৮ই এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৯ ই আগস্ট পর্যন্ত ৪৭ লাখ ৩২ হাজার জনগনকে টিকার ২ ডোজ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে , ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, ২২শে এপ্রিল (৮ই এপ্রিল এর দুই সপ্তাহ পর) থেকে ৯ই আগস্ট পর্যন্ত দেশে নতুন করোনা সংক্রমণের সংখ্যা ৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৪ জন।
এদের মধ্যে কত জন ব্রেক থ্রু সংক্রমণের শিকার, সে বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া গেল না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রেস রিলিজে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।
তবে IEDCR এর গত ১লা আগস্টের এক প্রেস রিলিজে , ১৩৩৪ জন করোনা আক্রান্ত রোগীকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন করে দেখা গেছে, এদের মধ্যে ৩০৬ জন ২ ডোজ টিকা নেওয়ার পরে সংক্রমিত হয়েছেন। অর্থাৎ, কোভিড রোগীদের মধ্যে ২২.৯৩% ব্রেকথ্রু সংক্রমণের শিকার।
এই সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আগ্রহী পাঠকরা বাংলাদেশে সম্ভাব্য ব্রেক থ্রু সংক্রমন হিসাব করে দেখতে পারেন ।
সিদ্ধান্ত
টিকার ২ ডোজ নিয়ে ৪০ হাজার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরটি বাংলাদেশের নয়, বরং ভারতের। শতকরা হিসেবে এই ৪০ হাজার বেশ নগণ্য সংখ্যা। শতকরা হিসেবে ০.৬৬%। কোভিড টিকার ক্ষেত্রে এই হার খুবই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই।
ভারতের খবরকে তথ্যসূত্র ছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রচার কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এই খবরটিকে বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করেছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?