যা দাবি করা হচ্ছে : কার্বলিক এসিড এর বোতলের মুখ খুলে রেখে দিলে নিকটে রাসেলস ভাইপারসহ কোনো ধরনের সাপ আসবে না। এমন দাবি করে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে যা পাওয়া যাচ্ছে : কার্বলিক এসিড দ্বারা এভাবে সাপ দমন করা যায়না। সরাসরি সাপের শরীরের উপরে কার্বলিক এসিড পড়লে সেটা তার ত্বকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, কিন্তু শুধুমাত্র ঘ্রাণের কারণে সাপ কার্বলিক এসিড থেকে দূরে থাকে না।
গুজবের উৎস :
‘কার্বলিক এসিড সাপ তাড়ায়’- এমন তথ্য দিয়ে তৈরি করা কয়েকটি বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে।
ডা অনিল ভৌমিক নামক এই আইডি থেকে করা পোস্টে বলা হয়েছে, প্রাণঘাতী বিষধর সাপ সহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড় দূরে রাখতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখে কার্বলিক এসিড বা ফেনল। এ রাসায়নিকটির গন্ধ সাপ সহ্য করতে পারে না। তাই ঘরের চারপাশে কার্বলিক এসিডের বোতলের মুখ খুলে রাখুন। এটি বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়, ফলে সাপ আর পোকামাকড় আসে না।
ই-কেম শপিং নামক এই পেজের পোস্টে বলা হয়েছে, মুলত সাপ তাড়ানোর মোক্ষম অস্ত্র হল কার্বলিক এসিড যার বাণিজ্যিক নাম হচ্ছে ফেনল। বাড়ির আশেপাশে কার্বলিক এসিডে ভরা কাঁচের বোতলের মুখ খুলে রাখলে কিংবা মাটিতে পুতে রাখলে বিষধর সাপের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া, Finis ব্র্যান্ড থেকে ‘Finis সাপ নিরোধক’ নামক একটি পণ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে ফেসবুক পেজ থেকে। এখানে ব্যবহৃত রাসায়নিকটির নাম মূল পোস্টে উল্লেখ করা না হলেও, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের জবাবে পেজের এডমিন স্বীকার করেছেন যে ‘সাপ নিরোধক’টা কার্বলিক এসিড নামক কেমিক্যাল।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান :
কার্বলিক এসিড কিংবা ফেনল নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, এটি একটি দুর্বল জৈব এসিড, যার সংকেত C6H6O । এটি জীবাণুনাশক হিসেবে বেশ কার্যকর । তবে ত্বকে অধিক পরিমাণে কার্বলিক এসিড লাগলে ত্বক পুড়ে যায় । মানুষ, সাপ কিংবা যেকোনো প্রাণীর ত্বকের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।
গত ২৪শে জুন,২০২৪ তারিখে কালের কন্ঠে প্রকাশিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের বর্তমান সভাপতি জনাব আবুল ফয়েজ বলেছেন, এটি (সাপ প্রতিরোধে কার্বলিক এসিড বা রাসায়নিক ব্যবহার) হাস্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিয়নের কর্মকৌশলে পরিষ্কার বলা আছে—আজ পর্যন্ত এমন কোনো কেমিক্যাল আবিষ্কৃত হয়নি, যেটি সাপকে আসতে নিরুৎসাহিতকরতে পারে। বরং এসব রাসায়নিক শিশু এবং পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাস কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন,
ভারতের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের এর চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদার এর বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাও জানাচ্ছে যে , কার্বলিক এসিডের কার্যকারিতার দাবিটা ভুল। তিনি বলেছেন , কার্বলিক অ্যাসিড ছড়ানো হলে সাপের গা পুড়ে যেতে পারে বলে তা খানিকক্ষণ দূরে থাকতে পারে, কিন্তু সেই অ্য়াসিড উবে গেলেই ফের সাপ এসে ঢুকবে।
দীর্ঘদিন ধরে এই উপমহাদেশে সাপ তাড়ানোয় কার্বলিক এসিডের ক্ষমতার কথা অনেকে বিশ্বাস করতেন। ওয়াইল্ডলাইফ থিংকার ওয়েবসাইটে জনাব সাওয়াবুল্লাহ হক এর লেখা এই নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ উপনিবেশ সময়ে কর্মরত বৃটিশ ফিজিশিয়ান ডক্টর ফেরার ( Joseph S. Fayrer) মূলত সাপ তাড়ানোতে কার্বলিক এসিডের ব্যবহারটি সকলের সামনে নিয়ে আসেন। ডাক্তার ফেরার এর লেখা ‘The Thanatophidia of India Being A Description Of The Venomous Snakes Of The Indian Peninsula With An Account Of The Influence Of Their Poison On Life With An Account Of The Influence Of Their Poison On Life; And A Series of Experiments’ বই থেকে কার্বলিক এসিড সংক্রান্ত কয়েকটি পরীক্ষার বিবরণ পাওয়া যায় । এরমধ্যে একটি পরীক্ষা হল, তিনি একটি পূর্ণবয়স্ক কোবরার উপর এক ড্রপ কার্বলিক এসিড ঢেলে দেন। দু‘ মিনিটের মধ্যে কোবরাটি তার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সাপের মধ্যে খিঁচুনি দেখা যায়, ছোবল দেওয়ার ব্যাপারে শক্তি হারিয়ে ফেলে যদিও সাপটি ফণা তুলে। সাপটি ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পায়। যদিও এতে অনেক সময় লাগে। একটি ছোট সাইজের কোবরার উপর একই পরিমাণ কার্বলিক এসিড ফেলাতে সাপটি মারা যায়। তবে কার্বলিক এসিডের বোতল খুলে রাখলেই সেই গন্ধ পেয়ে সাপ পালিয়ে যাবে, সরাসরি এমন কোনো পরীক্ষা ডক্টর ফেরার করেননি।
আলোচ্য নিবন্ধে জনাব সাওয়াবুল্লাহ হক সিদ্ধান্ত টেনেছেন এভাবে, কার্বলিক এসিডের প্রাক্টিস ফেরার তার পরীক্ষাতে যেরকমভাবে দেখান তা হল, তিনি সাপের শরীরে সরাসরি কার্বলিক এসিড প্রয়োগ করেন। কার্বলিক এসিড দূর্বল এসিড হলেও তা সরাসরি কোন শরীরে বিশেষ করে লোমহীন কোন দেহে সরাসরি প্রয়োগ করলে তা যে সেই প্রাণীর উপর বিভিন্ন ক্রিয়া ঘটাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বহুল প্রচলিত বক্তব্য হল কার্বলিক এসিড সাপকে দূরে রাখে। এবং ফেরার এর স্বপক্ষে বক্তব্যও দেন যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি কিন্ত ফেরার যে পরিক্ষা সমূহ করেন সেই পরীক্ষা ফেরার–এর বক্তব্য কে সঠিক প্রমাণ করে না।
ফেরার যেমন বলেন, “কার্বলিক এসিড অথবা শুধুমাত্র আলকাতরা দেয়াল, কাঠের সাথে ব্যবহার করে সাপ ঘর হতে দূরে রাখার জন্য এক কার্যকরী উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।” কিন্ত তার এই বক্তব্যের সপক্ষে সাপের উপর কার্বলিক এসিডের যে পরীক্ষাটি করেন তা হল “একটি কোবরা সাপের মুখের উপরে কয়েক ফোটা কার্বলিক এসিড ফেলেন। এরপর সাপটি যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকে। সাপটি ঘন ঘন তার মুখ বন্ধ এবং খুলতে আরম্ভ করে। সাপের পুরো শরীরে খিঁচুনির প্রকাশ পায়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাপটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ তিনি প্রথমে বললেন এই কেমিক্যালটি সাপকে দূরে রাখে আবার একই সাথে তিনি সেই প্রমাণটি দেখালেন সরাসরি সাপের উপর প্রয়োগ করে ! অর্থাৎ তার বক্তব্যের সাথে তার পরীক্ষাটি মিলনসই নয়।
এটা তখনই বুঝা যেত যদি ব্যাপারটা এরকম হত যে কার্বলিক এসিডের ঘ্রাণের কারণে সাপ কোন স্থানে প্রবেশ করছে না বা প্রবেশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তখন বিষয়টি বলা যেত যে কার্বলিক এসিড সাপকে দূরে রাখার জন্য কার্যকর । কিন্ত ফেরার তার আলোচিত বই The Thanatophidia of India Being A Description Of The Venomous Snakes Of The Indian Peninsula With An Account Of The Influence Of Their Poison On Life With An Account Of The Influence Of Their Poison On Life; And A Series of Experiments’-তে অসংখ্য পরীক্ষা করলেও এরকম কোন পরীক্ষা করে তিনি দেখিয়ে যেতে পারেন নি। সুতরাং কার্বলিক এসিড যে সাপ কে দূরে রাখে এ বিষয়টা বহুল প্রচলিত এক মিথ। যার প্রচলন ঘটে একজন বৃটিশ সার্জন জোসেফ এস ফেরার এর মাধ্যমে।
এই ‘মিথ’ বা ভ্রান্ত ধারণা খন্ডনের জন্য স্নেক রিসকিউ টিম বাংলাদেশ নামক সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি ছোট পরীক্ষা করা হয়েছিল। এই পরীক্ষায় শংখিনী জাতের একটি বিষধর সাপের কাছে একটি কার্বলিক এসিডের বোতলের মুখ খুলে রেখে দেওয়া হয়েছিল। দেখা গেল, এতে সাপের শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। বরং কিছুটা সময় সাপ ওই কার্বলিক এসিডের বোতল জড়িয়ে ধরেও অবস্থান করছিল। ভিডিওটি দেখতে পাবেন এখানে।
সিদ্ধান্ত :
উপর্যুক্ত আলোচনা ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এটা প্রমাণিত যে, কার্বলিক এসিড বা ফেনলের যে কার্যকারিতা দাবি করা হচ্ছে, তাঁর কোনো তত্ত্বগত বা পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, সাপ তাড়াতে কার্বলিক এসিড এর ক্ষমতাটা একটা ‘মিথ’ ছাড়া কিছু নয়। তাই যেসকল ফেসবুক পোস্টে কার্বলিক এসিডের সাপ তাড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে অতিরঞ্জিত তথ্য রয়েছে, ফ্যাক্টওয়াচ সেসকল পোস্টকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।