বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় বেশ কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাধ খোলা বা না খোলা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা এবং প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দেওয়াকে ভারতের ‘অমানবিকতা’ হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে ত্রিপুরার বিদ্যুৎ দফতরের মন্ত্রী রতন লাল নাথ বলছেন, ‘তারা যেটা বলছেন যে আমরা ডম্বুরের গেট খুলে দিয়েছি, সেটা সঠিক তথ্য নয়’। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যান্ত্রিক কৌশলে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতল ঘুরিয়ে একটি বাঁধ থেকে পানি নিষ্কাশনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে দাবি করছেন, এটিই ত্রিপুরার গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আওতাধীন ডম্বুর জলাধারের বাঁধ খুলে দেওয়ার সাম্প্রতিক দৃশ্য। তবে অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এটি ভারতের চন্ডীগড়ে অবস্থিত ‘শুকনা হ্রদ’ (shukna lake) এর বাঁধ খুলে দেওয়ার বছরখানেকের পুরনো দৃশ্য,যা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে বহুদূরে অবস্থিত ।
গুজবের উৎস
১ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের এই ভিডিওকে কেউ ত্রিপুরার ডম্বুর গেট খোলার দৃশ্য বলে দাবি করছেন, আবার কেউ কেউ একে তিস্তা বা ফারাক্কা বাধের গেট খোলার দৃশ্য বলেও দাবি মরছেন। অনেকে এবার নির্দিষ্ট কোনো স্থানের নাম উল্লেখ না করে, কেবলমাত্র ‘ভারতের একটি বাঁধ এর গেট খোলার দৃশ্য’ হিসেবে একে উল্লেখ করছেন। তবে সাম্প্রতিক ডামাডোলে অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারীই একে ত্রিপুরার গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আওতাধীন ডম্বুর জলাধার এর বাঁধ এর দৃশ্য বলে ধরে নিচ্ছেন।
ভারতের ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চলে গত কয়েকদিন ধরে একটানা ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অথচ এই ভিডিওতে সেতুর রেলিং এবং বাধের অবকাঠামো সম্পূর্ণ শুকনো দেখা যাচ্ছে এবং কোথাও বৃষ্টির কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না । এখানে দৃশ্যমান কর্মীদের কারো শরীরেও ছাতা,রেইনকোট বা বৃষ্টি প্রতিরোধী কোনো সরঞ্জাম নেই। ফলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে এটা সাম্প্রতিক সময়ের ত্রিপুরার ডম্বুর গেট এলাকার দৃশ্য নয়।
এছাড়া একই ভিডিওটি ফেসবুকে ২১শে জুলাই এবং ২৮শে জুলাই তারিখেও দেখা যাচ্ছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই তাদেরকে চন্ডীগড়ের শুকনা লেক হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছিল। এসব ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে, উক্ত বাঁধের ফ্লাডগেট (অতিরিক্ত পানি নির্গমনের রাস্তা) কেবলমাত্র কয়েক মিনিটের জন্য পরখ করার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল।
অনুসন্ধানে দেখা গেল, চন্ডীগড়ের শুকনা হ্রদের গত কয়েক বছরে একাধিকবার ফ্লাডগেট খুলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার খবরাখবর পত্রিকাতে ছাপাও হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন দেখুন এখানে, এখানে ,এখানে।
এসব ঘটনার বিভিন্ন সময়ে আপলোড করা একাধিক ভিডিওও ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে। এমন কয়েকটা ভিডিও দেখতে পাবেন এখানে, এখানে,এখানে, এখানে। এসব ভিডিওতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রমিকদের ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়াতে উক্ত বাঁধের উপরে কাজ করতে দেখা গেলেও, বাঁধের অবকাঠামো একই দেখা যাচ্ছে।
গুগল ম্যাপ এ চন্ডীগড়ের শুকনা হ্রদ সম্পর্কে জনৈক রোহান জিন্দাল একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে কয়েকটি ছবি আপলোড করেছেন। এসব ছবির সাথেও ভাইরাল ভিডিওর মূল স্থাপনাগুলো (একটি কংক্রিটের সেতু, এবং তার পাশেই সেতুর চেয়ে একটু নিচু লোহার বাঁধ) মিলে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, ভারতের চন্ডীগড়ে অবস্থিত এই শুকনা হৃদ এ অতিবৃষ্টির কারণে পানির পরিমাণ বিপদ সীমার উপরে উঠে গেলে ফ্লাডগেট খুলে দেওয়া হয়। অতিরিক্ত পানি তখন শুকনা হ্রদের পাশের শুকনা চো (shukna choe- পাঞ্জাবি ভাষায় ‘চো’ অর্থ প্রস্রবণ) দিয়ে প্রবাহিত হয়, যা চন্ডীগড় প্রদেশের মধ্যেই অবস্থিত। গুগল ম্যাপ থেকে অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই শুকনা হ্রদ এর অবস্থান বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হিলি স্থল বন্দর থেকে ১৮১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ এই অতিরিক্ত পানি প্রবাহ কোনোভাবেই পার্শবর্তী বাংলাদেশে এত দূর পথ পাড়ি দিয়ে প্রবাহিত হতে পারবে না। যদিও ভাইরাল পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে যে এই বাঁধ থেকে নির্গত পানিই বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করেছে।
সিদ্ধান্ত
ভাইরাল পোস্টগুলোতে মূলত দু’টি দাবি করা হয়েছে-
১। এটি ভারতের সীমান্তবর্তী ডম্বুর,বা তিস্তা বা ফারাক্কা বাধের দৃশ্য
২। সম্প্রতি এই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে এবং অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে বন্যা সৃষ্টি করেছে।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখানো হল যে এই দু’টি দাবিই ভুল। এটি ভারতের চন্ডীগড়ের ‘শুকনা হ্রদ’ এর উপর নির্মিত বাঁধের দৃশ্য, এবং এখান থেকে অপসারিত অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে চলে আসা সম্ভব নয়।
সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এ সকল পোস্টকে ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।