আমেরিকান তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং টেসলা ও স্পেস এক্স এর প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক এর চেহারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্য এক ব্যক্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করছেন, চীন তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলন মাস্ক এর ক্লোন (একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ) তৈরি করেছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচ এর অনুসন্ধানে এই দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
গুজবের উৎস
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এই গুজবটা ভাইরাল হয়। টিকটক, টুইটার,ফেসবুক,ইউটিউব এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছোট ভিডিওতে জনৈক ব্যক্তিকে একটি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চাইনিজ মান্দারিন ভাষায় কিছু বলতে শোনা যায়। এই ভিডিও, এবং ভিডিও থেকে সংগ্রহ করা স্থিরচিত্র নিয়ে পরবর্তী কয়েকদিনে অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়ে ।
চীন দেশে পাওয়া গেল ইলন মাস্কের ক্লোন , কিংবা চীন সফলভাবে ইলন মাস্কের ক্লোন তৈরি করেছে- এমন পোস্ট এবং পোস্টার ভাইরাল হইয়ে পড়ে কয়েক দিনের মধ্যে ।
অনেকে মিম কিংবা স্যাটায়ার হিসেবে এই ছবি পোস্ট করেন ।
আবার অনেকে একে সত্য তথ্য ভেবে নিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক তথ্য’ কিংবা ‘আপনি কি জানেন?’ ক্যাপশন দিয়ে পোস্ট কিংবা শেয়ার করতে থাকেন। যার ফলে সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে।
চীনের স্থানীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম Douyin এ 马斯克小迷弟-中国分克 নামক একাউন্ট থেকে এই ভিডিও আপলোড করা হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। 马斯克小迷弟-中国分克 এর অনুবাদ হল- Musk’s fan — China’s version of Musk , যাকে আমরা বাংলায় – ‘ইলন মাস্ক এর চাইনিজ ছোটভাই’ বলতে পারি ।
ডিসেম্বর এর ৪, ৫,১১,১২,১৯,২২ তারিখে এই একাউন্ট থেকে ছোট ছোট কয়েকটা ভিডিও আপলোড করা হয় , যেখানে একটি টেসলা গাড়ির সামনে থেকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় উক্ত ব্যক্তিকে ইলন মাস্ক এর বাচনভঙ্গি নকল করে চাইনিজ ভাষায় কিছু বলতে শোনা যায়।
এ সকল ভিডিও পরবর্তীতে ভাইরাল হলে, এবং আমেরিকান ইলন মাস্ক এর সাথে তাকে তুলনা করা শুরু হলে সেই খবরগুলোও এই চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়।
radiichina.com এর এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাইরাল হওয়া উক্ত ব্যক্তি চীনের সুচৌ (Suzhou) শহরের বাসিন্দা ।
তবে তার নাম কিংবা বিস্তারিত পরিচয় ফ্যাক্টওয়াচ খুঁজে পায় নি।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
নিউ ইয়র্ক পোস্ট, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ,হিন্দুস্তান টাইমস সহ বিভিন্নআন্তর্জাতিকপত্রিকায় এই ‘নকল ইলন মাস্ক’ কে নিয়ে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই ভিডিও কোনো মানুষের ভিডিও, নাকি ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে , এ বিষয়ে পত্রিকাগুলোতে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে চীনের ‘ক্লোন’ তৈরির কোনো তথ্য কোনো সংবাদমাধ্যম জানায়নি।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক ফেসবুক পেজ বিজ্ঞানপ্রিয় ও এটাকে সম্ভাব্য ডিপফেক হিসেবে উল্লেখ করেছে।
মানুষের ক্লোন তৈরি করা কি সম্ভব ?
ক্লোনিং হলো অতি অত্যাধুনিক একটি প্রযুক্তি যার মাধ্যমে কোনো প্রাণীর নিউক্লিয়াস ব্যবহার করে হুবহু সেই প্রাণীর অনুরূপ আরেকটি প্রাণী করা হয় – যা জেনেটিক এবং ফিনোটাইপিক উভয় দিক থেকেই অনুরূপ হবে। সোজা কথায় ক্লোনিং হল কোন জিনগত ভাবে কোন কিছুর হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করা।
১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডে ডলি নামের একটি Finn-Dorset প্রজাতির ভেড়া ক্লোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয় , যা তার ৬ বছর বয়সী নামবিহীন পূর্বপুরুষের অনুরূপ ছিল।
এসকল ক্ষেত্রে somatic cell nucleus transfer (SCNT) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। যে প্রাণীর (নিউক্লিয়ার ডোনার) ক্লোন করতে হবে, তার শরীর থেকে একটি সোমাটিক কোষ নিয়ে সেখান থেকে নিউক্লিয়াস বের করে সেই নিউক্লিয়াসটি অন্য কোনো ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। পরে সেই ডিম্বাণুকে কোনো গর্ভে স্থাপন করা হলে নির্দিষ্ট সময় পরে নিউক্লিয়ার ডোনার এর ক্লোন বাচ্চা তৈরি হবে, যে বাচ্চাটার সকল বৈশিষ্ঠ্য মূল ডোনারের সমান হবে।
এভাবে বিভিন্ন প্রাণীর ক্লোন তৈরি করা হলেও এখনো কোনো দেশে মানুষের ক্লোন তৈরি করা হয়নি। সায়েন্স ফিকশন সিনেমা কিংবা বইতে মানুষের ক্লোন দেখা গেলেও বাস্তবে এটা দেখা যায়নি কখনোই। নৈতিক কারণে অনেক দেশে মানুষের ক্লোন তৈরি কিংবা এ নিয়ে গবেষণা করা আইনত নিষিদ্ধ।
২০০২ সালের ডিসেম্বরে ‘ইভ’ নামের একটি ক্লোন শিশুর গুজব শোনা গিয়েছিল। ফ্রেঞ্চ রসায়নবিদ , এবং রায়েল ধর্মের ধর্মগুরু Brigitte Boisselier দাবি করেছিলেন, তাদের গবেষণার মাধ্যমে তারা প্রথমবারের মত একটি নিঃসন্তান দম্পতিকে ‘ইভ’ নামক ক্লোন শিশু উপহার দিতে যাচ্ছেন। তবে সাংবাদিকদের তারা উক্ত শিশুর অবস্থান, পরিচয় কিংবা সনাক্তকারী কোনো তথ্য কখনোই দেননি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, রায়েল ধর্ম , এবং রায়েল ধর্মের অঙ্গ সংগঠন Clonide কে প্রচারের আলোয় আনার জন্য Brigitte Boisselier ইভ নামক ক্লোন শিশুর ফেক নিউজ ছড়িয়েছিলেন।
ইভ এর গুজবের পরে বিশ্বের কোনো দেশ থেকেই মানব ক্লোন সম্পর্কে বড় কোনো ঘটনা কিংবা গুজব শোনা যায়নি। বর্তমানে মানব ক্লোন করার প্রচেষ্টা কেউ করছে না বলেই ধরে নেয়া যায়।
এছাড়া, যদি এমন ধরনের কোনো ক্লোন কেউ তৈরি করেও থাকে, তাহলে সেই ক্লোন শিশুটির বয়স হবে মাত্র কয়েকদিন। (অর্থাৎ, ৫০ বছর বয়সী ইলন মাস্ক এর ক্লোন আজ তৈরি করা হলে সেই ক্লোনের বয়স হবে কয়েক দিন মাত্র) ক্লোন এর বয়স ইলন মাস্ক এর সমান হবে না ।
কাজেই , ‘চীন ইলন মাস্কের ক্লোন তৈরি করেছে’- দাবিটা যদি তর্কের খাতিরে সত্য ধরেও নেই, তাহলেই সেই ক্লোন এর বয়স হবে অনেক কম। ইলন মাস্কের সমবয়সী হবে না।
৫০ বছর বয়সী ইলন মাস্কের ক্লোন এখন পেতে হলে সেই ১৯৭২ সালেই ক্লোন বানিয়ে রাখতে হবে, যখন পৃথিবীতে ক্লোনিং প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়নি।
অর্থাৎ ভাইরাল ছবিটা কোনো ভাবেই ইলন মাস্কের জৈবিক ক্লোন হতে পারে না।
সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এ সংক্রান্ত স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গাত্মক পোস্টগুলো ছাড়া অন্যগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে ।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?