চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নিয়ে দেশ-বিদেশে অপতথ্য প্রচার

126
চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নিয়ে দেশ-বিদেশে অপতথ্য প্রচার
চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নিয়ে দেশ-বিদেশে অপতথ্য প্রচার

বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান তাঁর অনুসারীরা। এ সময় আদালত এলাকায় হামলা ও ভাঙচুরের সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হয়েছেন। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে এমন ঘটনার কিছুক্ষণ পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও একাউন্ট থেকে দাবি করা হয় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় একাধিক মিডিয়া থেকে একই দাবিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অপরদিকে আমেরিকাভিত্তিক গণমাধ্যম রয়টার্স থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুসলিম আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করেছে। যদিও বাংলাদেশী গণমাধ্যম ঘটনার শুরুতেই নিহত সাইফুল ইসলামের মৃত্যুর কারণ ও পরিচয় নিশ্চিত করেছে। মূলত, সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আদালতে নিয়মিত আইনজীবী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাছাড়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হলেন শুভাশীষ শর্মা নামের এক ব্যক্তি। তাই দেশ-বিদেশে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মৃত্যু নিয়ে যেই দাবি করা হয়েছে তা সত্য নয়।

ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

বিস্তারিত:

২৬ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে শুনানি শেষে জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। সাড়ে ১২টার দিকে আদালত প্রাঙ্গণে তাকে বহনকারী প্রিজনভ্যান আটকে দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন তার অনুসারীরা। পরে আদালত এলাকায় ভাঙচুর শুরু করেন তারা। পাশাপাশি আইনজীবীদের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। ২টা ৫০ মিনিটের দিকে পুলিশ ও বিজিবি লাঠিপেটা শুরু করে। পরপর কয়টি সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ে। তখন সেখানে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে যানা যাচ্ছে, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম সহকারী সরকারি কৌঁসুলি। (যদিও পরবর্তী প্রতিবেদনগুলোতে দেখা গেছে, সাইফুল ইসলাম না রাষ্ট্রপক্ষের না চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবি ছিলেন। বরং তিনি আদালতের একজন নিয়মিত আইনজীবী ছিলেন) প্রতিবেদনের শুরুতে প্রথম আলো জানাচ্ছে, চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সংঘর্ষের সময় একজন আইনজীবী নিহত হয়েছেন। আবার চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর বরাতে জানাচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা ওই আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে

একই ঘটনার উপরে ইউএনবি নিউজ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আদালতের নিচতলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা তাকে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল সিনেমা লেনে নিয়ে গিয়ে মারধরের পর কুপিয়ে হত্যা করে।

উল্লেখ্য, বিষয়টি নিয়ে “চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন ঘিরে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, আইনজীবীর মৃত্যু” শিরোনামে বিবিসি বাংলা থেকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সুদীর্ঘ প্রতিবেদনটি থেকে জানা যাচ্ছে, শুনানি শেষে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। তবে প্রিজন ভ্যান ঘিরে বিক্ষোভ করতে থাকেন তার অনুসারীরা। এক পর্যায়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় আদালতসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা। ভাংচুর করা হয় আশেপাশের বিভিন্ন দোকানসহ স্থাপনায়। সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ আইনজীবীসহ বেশ কিছু মানুষ আহত হন। এছাড়া বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ছাত্রজনতার একটি অংশ। কয়েক ঘণ্টা ধরে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এ সময় আদালত প্রাঙ্গনে সংঘর্ষের ঘটনায় সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে একজন নিহত হন।

উক্ত প্রতিবেদন থেকে এটিও জানা যাচ্ছে যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “জামিন নামঞ্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রথমে নামঞ্জুর হওয়ার পরে আমরা উচ্চ আদালতে অর্থাৎ মহানগর দায়রা জজ আদালতে আমরা ফৌজদারি মিস মামলা করেছি। আদালত আমাদের মিস মামলা গ্রহণ করে আগামীকাল শুনানির জন্য রেখেছেন”।

এখানে লক্ষণীয় যে, বিবিসি বাংলা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হিসেবে শুভাশীষ শর্মার নাম উল্লেখ করেছে। অপরদিকে একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সাইফুল ইসলাম আলিফ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। । কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম অল্ট নিউজ চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন চ্য (রাজ্জাক) এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বা প্রসিকিউশনের প্রতিনিধিত্ব করেননি। তিনি একজন সাধারণ আইনজীবী।

চট্টগ্রামের সংঘর্ষে আইনজীবীদের মধ্যে এ পর্যন্ত সাইফুল ইসলাম আলিফ নহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা মারা গেছেন এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একটি গণমাধ্যমেও এমন খবর প্রকাশিত হয়নি। বরং একজন সাধারণ আইনজীবীকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী দাবি করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত যে, চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করা হয়। গত ৩১শে অক্টোবর বিএনপি নেতা ফিরোজ খান (পরে বহিষ্কৃত) মামলাটি করেন। ১৯ জনকে আসামি করা হয় এ মামলায়।

সুতরাং, ভারতীয় গণমাধ্যম বা অন্যকোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুসলিম আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে দাবিটি পরিপূর্ণ ভিত্তিহীন। বরং আইনজীবীকে সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবার বাংলাদেশী কিছু গণমাধ্যমের দাবি, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সমর্থকদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত হয়েছেন।

সঙ্গত কারণে, ভিত্তিহীন দাবিগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” সাব্যস্ত করেছে।

No Factcheck schema data available.

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে

এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে
ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh