সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবির সাথে সংশ্লিষ্ট ক্যাপশনে বলা হয়েছে, “২০২৪ সালের ৩য় শ্রেণীর ইসলাম শিক্ষা বইয়ের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষা বোর্ড ইসলামকে অবমাননা করছে এবং দেশে ধর্মীয় সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। তবে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্য ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা নামক বইয়ের ১২ নং পৃষ্ঠায় আলোচিত বইয়ের পৃষ্ঠার অনুরূপ কোন ছবি নেই। এমনকি এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্তরের কোন পাঠ্যপুস্তকে আলোচিত বইয়ের পৃষ্ঠার অনুরূপ কোন ছবি পাওয়া যায়নি। বরং সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিটির উৎস অনুসন্ধান করে দেখা গেছে সেটা ‘লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত আলোর দিশারি শিক্ষার্থীদের অনুশীলন বই – ১ শীর্ষক বইয়ের পৃষ্ঠা, যার সাথে সরকার বা এনসিটিবি’র কোন সম্পর্ক নেই। তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোর দাবিকে বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করছে।
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটিতে বইয়ের পৃষ্ঠা নাম্বার দেওয়া আছে ১২ এবং ঐ পৃষ্ঠায় আদম ও হাওয়ার স্বর্গে আপেল খাওয়ার একটি কাল্পনিক দৃশ্য এঁকে নিচে লেখা রয়েছে: “পাঠ – ৫ মানুষের পাপে পতন। আদম হাওয়া পাপ করল।” এখন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৪ সালের তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্য ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ের ১২ নং পৃষ্ঠায় এমন কোন ছবি আসলে আছে কিনা তা যাচাই করে দেখা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকগুলো ঘেঁটে দেখেছি। এনসিটিবির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক স্তরের তৃতীয় শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইটির বাংলা ভার্সন পড়ে দেখা গেছে সেখানে ১২ নং পৃষ্ঠায় কিংবা তার আশেপাশে আদম ও হাওয়ার কোন ছবি নেই। বরং উক্ত বইয়ের ১২ নং পৃষ্ঠায় পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে কিভাবে ওজু করতে হয় সেটা আলোচনা করা হয়েছে। আবার, তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্য আমার বাংলা বইটির বাংলা ভার্সন ঘেঁটে দেখা গেছে উক্ত বইয়ের ১২ নং পৃষ্ঠায় বিভিন্ন ফলাচিহ্নের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আমরা পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী এবং প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকগুলো ঘেঁটে দেখেছি। প্রাথমিক স্তরের প্রথম শ্রেণীর পাঠ্য আমার বাংলা বইটির বাংলা ভার্সন পড়ে দেখা গেছে উক্ত বইয়ের ১২ নং পৃষ্ঠায় বাঘ ও রাখাল বালকের গল্পটি রয়েছে। আবার, দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠ্য আমার বাংলা বইয়ের বাংলা ভার্সনের ১২ নং পৃষ্ঠায় ডালিমকুমার ও কঙ্কাবতীর গল্প রয়েছে। উল্লেখ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর আমার বাংলা বই পাঠ্যপুস্তকটি ব্যতীত আর দুটো বই রয়েছে, যথা: English for Today এবং প্রাথমিক গণিত।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক আমার বই এবং এসো লিখতে শিখি পড়ে দেখা গেছে সেগুলোর ১২ নং পৃষ্ঠায় সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত বইয়ের পৃষ্ঠার অনুরূপ কোন ছবি নেই। তাছাড়া, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম, দ্বিতীয়, এবং তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোর মাঝে আমার বাংলা বই নামক পাঠ্যপুস্তকটি সকল স্তরেই পড়ানো হয় বিধায় সেগুলো আমরা ঘেঁটে দেখি নি। অন্যদিকে, ইবতেদায়ি স্তরের পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা নামক বইটি নেই।
অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিটির উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা Muhammad Kamruzzaman Rana নামক ফেসবুক প্রোফাইল থেকে গত ০১ জানুয়ারি ২০২৪ এ শেয়ারকৃত দুটো ছবি খুঁজে পেয়েছি। ছবি দুটোর মাঝে প্রথম ছবিটির সাথে আমাদের আলোচিত ছবির মিল রয়েছে। অন্য ছবিটিতে আলোর দিশারি শিক্ষার্থীদের অনুশীলন বই – ১ শীর্ষক বইয়ের ভেতরের একটি পৃষ্ঠা দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ছবিটিতে আরও দেখা যাচ্ছে উক্ত বইটি প্রকাশ করেছে লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। পরে ঐ প্রতিষ্ঠানের নাম ধরে অনুসন্ধান করে আশানুরূপ কোন ফল পাওয়া যায় নি। তবে লিংকডইন নামক সামাজিক মাধ্যমে লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন ব্যক্তির প্রোফাইল পাওয়া গেছে, যেখানে লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে নেদারল্যান্ডসের একটি আইএনজিওর সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আজকের পত্রিকা নামক বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমের ফ্যাক্টচেক বিভাগ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর সদস্য অধ্যাপক মোঃ মশিউজ্জামানের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, “আলোর দিশারি শিক্ষার্থীদের অনুশীলন বই-১ নামে এনসিটিবির কোনো বই নেই। এনসিটিবির বইয়ের তালিকা ওয়েবসাইটেই দেওয়া আছে। লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সঙ্গেও এনসিটিবির কোনো সম্পর্ক নেই।”
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিটি এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বই থেকে নেওয়া হয়নি। বরং সেটি লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামক একটি এনজিও কর্তৃক প্রকাশিত বই, যার সাথে এনসিটিবির কোন সম্পর্ক নেই এবং যা জাতীয় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্তও নয়৷
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।