বেশ কিছু বছর ধরে জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই সামাজিক মাধ্যমে একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে যে, আম খাওয়ার পর কোমল পানীয় পান করা উচিত নয়। কেননা, আমের সাইট্রিক অ্যাসিডের সাথে কোমল পানীয়ের জৈব অ্যাসিড মিলে শরীরে বিষক্রিয়া হয় এবং এর ফলে মৃত্যু হতে পারে! তবে, ফ্যাক্টওয়াচ এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে যে, আম এবং কোমল পানীয় একসাথে খেলে কিছু হয় না এবং আমে যে সামান্য পরিমাণ সাইট্রিক অ্যাসিড আছে তার সাথে কোমল পানীয়ের ফসফরিক অ্যাসিড তেমন বিক্রিয়া করে না। তবে, সাইট্রিক অ্যাসিড ও ফসফরিক অ্যাসিড একসাথে ফুড অ্যাডিটিভ (Additive) হিসেবে ব্যবহার করার অনুমোদন নেই কারণ এই দুটো বেশি পরিমাণে থাকলে বিক্রিয়া করে। এর আগে কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসাথে খেলে তিনটি সাপের কামড়ের সমান বিষক্রিয়া হয়ে মৃত্যু হতে পারে বলে একটি পোস্ট ছড়িয়েছিল এবং ফ্যাক্টওয়াচ সেই দাবি খন্ডন করেছিল। কেবল বাংলাদেশেই নয়, ভারত, থাইল্যান্ড, এবং আফ্রিকা’র বেশকিছু দেশে আম, কাঁঠাল, ডুরিয়ান (সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফল) খেয়ে কোমল পানীয় পান করলে শরীরে বিষক্রিয়া হতে পারে বলে দাবি করা হয়েছিল। তবে, বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা এইসব দাবিগুলোকে বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে নাকচ করে দিয়েছে। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত “আম খেয়ে কোমল পানীয় পান করলে মৃত্যু হতে পারে” এই দাবি সংবলিত পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করেছে। তাছাড়া, আমের পাশাপাশি কাঁঠাল এবং ডুরিয়ান নিয়েও একইরকম দাবি উঠেছিল বিধায় পুরো বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করতে একটি ফ্যাক্ট-ফাইল তৈরি করেছেন মোহাম্মদ আরাফাত।
অনুসন্ধান:
আম এবং কোমল পানীয় একসাথে খেলে কি বিষক্রিয়া হয়ে মৃত্যু হতে পারে?
না, আম এবং কোমল পানীয় একসাথে খেলে মৃত্য হবে না। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, “আমের সাইট্রিক অ্যাসিড এবং কোমল পানীয়ের জৈব অ্যাসিড একত্রিত হয়ে বিষ তৈরি করে।” এই দাবিটির যথাযথতা কতটুকু তা নিশ্চিত হতে আমরা খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞানের গবেষক সৃজনী মন্ডলের সাথে যোগাযোগ করি। আম এবং কোমল পানীয়ের অ্যাসিডের বিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমের সাইট্রিক অ্যাসিড নিজেই একটি জৈব অ্যাসিড। অন্যদিকে, কোমল পানীয়তে কোন জৈব অ্যাসিড নেই — যেমনটি দাবি করা হচ্ছে। বরং, কোমল পানীয়তে একটি অজৈব ফসফরিক অ্যাসিড রয়েছে। আমে সাইট্রিক অ্যাসিড থাকলেও খুবই সামান্য (০.২% – ১.৩%) পরিমাণে আছে এবং এতটুকু অ্যাসিড ফসফরিক অ্যাসিডের সাথে তেমন কোন বিক্রিয়া করে না। তবে, সাইট্রিক অ্যাসিড ও ফসফরিক অ্যাসিড একসাথে ফুড অ্যাডিটিভ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমোদন নাই। কারণ, দুটোই বেশি থাকলে এরা বিক্রিয়া করে এবং একটি জেনোটক্সিক উপাদান তৈরি করে। এটা বিষ নয়, কিন্তু ডিএনএ’র জন্য ক্ষতিকর। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টে যেভাবে দাবি করা হয়েছে, আম আর কোমল পানীয় খাওয়ার সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে — তেমনটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”
ধারণা করা যাচ্ছে, আম খেয়ে কোমল পানীয় পান করার ফলে বিষক্রিয়া হয়ে মৃত্যুর গুজবটি ভারত থেকে ছড়িয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, এবং অন্যান্য ভাষায় যে পোস্টগুলো পাওয়া গেছে সেখানে বলা হয়েছে ভারতের চন্ডীগড়ে গিয়ে কয়েকজন পর্যটক আম খাওয়ার পর কোমল পানীয় পান করে অজ্ঞান হয়ে যান এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এই বিষয়ে AFP Fact-Check, The Quint, Factly, Dubawa, Vishva News, The Indian Express বিভিন্ন সময়ে ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে আলোচিত দাবিটিকে নাকচ করে দিয়েছিল।
কাঁঠাল বা ডুরিয়ান খেয়ে কোমল পানীয় পান করলে কি মৃত্যু হতে পারে?
কাঁঠাল খেয়ে কোকাকোলা পান করলে তিনটি সাপের কামড়ের সমান বিষক্রিয়া হয়ে মৃত্যু হতে পারে বলে একটি গুজব ছড়িয়েছিল। তবে, এই বিষয়ে ফ্যাক্টওয়াচ একজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিল যে, কাঁঠাল ও কোমল পানীয়ে এমন কোন উপাদান নাই যা একসাথে বিক্রিয়া করে বিষ উৎপন্ন করতে পারে। তবে, কাঁঠালের আঁশ এবং কোমল পানীয়ের কার্বনেশনের কারণে বদহজম বা পেটে ব্যথা হতে পারে অনেকের। এতে কেউ মারা যায় না। বড়জোর ডায়রিয়া হতে পারে। এর বেশি কিছু না।
আম এবং কাঁঠালের পাশাপাশি ডুরিয়ান (কাঁঠালের মতো দেখতে কাঁটা-যুক্ত এবং সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফল) খেয়ে কোকাকোলা পান করলে সেটি প্রাণঘাতী হতে পারে বলে দাবি করা হয়েছিল। এই বিষয়ে ১০ জুলাই ২০২০ এ প্রকাশিত এএফপি থাইল্যান্ডের একটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদনে Chulalongkorn University – এর মেডিসিন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার পিয়াপান প্রেক্ষাপানিশ (Piyapan Prueksapanich) এর বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে যে, “ডুরিয়ান এবং কোকাকোলা একসঙ্গে খাওয়াটা বিপদজনক নয় এবং এই দুটো একসাথে খেলেও তা মানবদেহকে তীব্রভাবে বিষাক্ত করে তুলতে পারে না। তবে, স্থূলতা (Obesity) বর্জনের জন্য অন্যান্য উচ্চ শর্করাযুক্ত খাদ্যের মতো ডুরিয়ান এবং কোকাকোলা একসঙ্গে বেশি খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু ডুরিয়ান এবং কোকাকোলা একসাথে খেতেও নিষেধ করা হয়নি।” তাছাড়া, ডাক্তার পিয়াপান আরও বলেন যে, “ডুরিয়ান এবং অ্যালকোহল একসঙ্গে খাওয়াটা মানবদেহের জন্য বিপদজনক হতে পারে। ডুরিয়ান খেয়ে অ্যালকোহল পান করলে তা মানবদেহে অ্যালকোহলের বিষক্রিয়ার লক্ষণকে আরও বেশি মারাত্মক করে তুলতে পারে এবং কিছুক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।”
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, আম, কাঁঠাল, কিংবা ডুরিয়ান খেয়ে কোমল পানীয় পান করলে শরীরে বিষক্রিয়া হয়ে মৃত্যু হয় না। আম, কাঁঠাল কিংবা ডুরিয়ানের আঁশের সাথে কোমল পানীয়ের কার্বনেশনের কারণে পেটে গ্যাস জমে বদহজম হতে পারে। যেহেতু আম, কাঁঠাল, কিংবা ডুরিয়ান উচ্চ শর্করাযুক্ত ফল, সেহেতু উক্ত ফলগুলো খেয়ে কার্বনেটেড কোকাকোলা বা অন্যান্য কোমল পানীয় অধিক পরিমাণে পান না করাটাই শ্রেয়।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোর দাবিকে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।