গরু এবং চিতাবাঘের কয়েকটি ছবি সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ভারতের আসামে একটি গরুর কাছে প্রতিরাতে জঙ্গল থেকে একটি চিতাবাঘ এসে দেখা করে যায়। শৈশবে এই চিতাবাঘটিকে একটি দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গরুটি মাতৃস্নেহে লালনপালন করেছিল এবং সেই সম্পর্ক তাদের মধ্যে পরবর্তী জীবনেও রয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, ঘটনাটি প্রায় ২০ বছরের পুরনো। এটি আসামের নয়, বরং ভারতের গুজরাটের। চিতাবাঘ এবং গরুর মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছে ঠিকই, তবে তাদের শৈশবের যোগসূত্রের গল্পটি সম্পূর্ণ গুজব।
ভাইরাল এই পোস্টে বলা হচ্ছে- ঘটনাটি আসামের।একজন লোক গরুটি কিনে এনে তার উঠুনে বেঁধে রাখে।কিন্তু প্রত্যেক গভীর রাতে কুকুরের খুব ঘেউঘেউ ডাকাডাকি শুনতে পায়।তারা ভাবল এই লকডাউনের সময়ে হয়তো চোরের উৎপাত বেড়েছে।তাই তারা সেখানে সিসিটিভি সেট করে।পরের দিন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তো সবাই হতবাক, গরুটির পাশে একটা চিতা ঘুরঘুর করছে।
পরে তারা যার কাছ থেকে গরুটি কিনেছিল তার কাছে যায় ব্যাপারটা জানতে।আর জানতে পারে যে এই চিতাবাঘটির জন্মের ২০ দিন বয়সে তার মা চিতা বাঘিনী মারা যায়।তারপরে এই গরুটির দুগ্ধ পান করে সে বাঁচে।তাই সে তার ত্রাণ কর্ত্রী দুধমা কে ভুলে যায়নি, প্রত্যেক রাত্রে দেখা করতে আসে।মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।মা ও আদর করে।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
এই ঘটনা সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো খবর পাওয়া যায় ভারতের টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে, ২০০২ সালের ২৫শে অক্টোবর প্রকাশিত“The love story of a leopard and a cow”শীর্ষক এই প্রতিবেদনে। সাংবাদিক শ্যাম পারেখ এর লেখা ছবিবিহীন এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,অক্টোবর ২০০২ থেকে গুজরাট রাজ্যের বদোদরা জেলার আনতোলি (Antoli) গ্রামবাসীরা এক অদ্ভূত ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। মাঝে মাঝেই রাতের বেলা পাশের ভুট্টাক্ষেত থেকে এক বছর বয়সী একটি চিতা বাঘ (Leopard) এসে গ্রামের একটি গৃহপালিত ৩ বছর বয়সী গরুর সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। গরুটি চিতাবাঘটি কে চেটে আদর করে দেয়। চিতাবাঘটিও নীরবে আদর গ্রহণ করে এবং মুখ দিয়ে মৃদু গরগর শব্দ করে। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই চিতাবাঘটি চলে যায়।
এই প্রতিবেদনে এদেরকে মা-সন্তান হিসেবে কোনো গুজবের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বরং হিন্দি সিনেমার রেফারেন্স টেনে এদেরকে প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিল।
এমন অদ্ভূত আচরণের কারণ হিসেবে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে বদোদরা জেলার বন সংরক্ষক এইচ এস সিং বলেছিলেন,মাঝে মাঝে প্রাণীদের আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। এই চিতাবাঘটি গ্রামের পাশে বসবাস করে, পুরাপুরি জঙ্গলে থাকেনা সে। সম্ভবত এ কারণে তার আচরণে পুরোপুরি বন্য আচরণের বদলে এই ধরনের পরিবর্তন এসেছে ।
পরবর্তী সময়ে জি নিউজ এর একটি এক্সক্লুসিভ ভিডিও ক্লিপ পাওয়া যাচ্ছে ইউটিউবে। ২০০৮ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর এটি আপলোড করা হলেও ভিডিওর বিষয়বস্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে, এটি ২০০৩ সালের মে মাসের ১০ তারিখের ভিডিও ।
এখানে রাতের বেলায় চিতাবাঘ এবং গরুটির কিছু ছবি এবং ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। একজন গ্রামবাসী এখানে সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, আগের বছরে চিতাবাঘটির মা বনবিভাগের হাতে ধরা পড়েছিল। মা-হারা হওয়ার কারণে চিতাবাঘটি বনে-জঙ্গলে না ঘুরে লোকালয়ে ঘোরার অভ্যাস রপ্ত করেছে।
লক্ষণীয়, জি-নিউজের এই প্রতিবেদনেও ‘গরুটি শৈশবে চিতাবাঘকে দুধ পান করিয়েছিল বা লালন পালন করেছিল’—এমন কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
ঘটনাটার সবচেয়ে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে অনফরেস্টডটকম এর এই নিবন্ধে। নিবন্ধ আপলোডের তারিখ হিসেবে ২০১৪ সালের ৬ই এপ্রিল দেওয়া হলেও, বিষয়বস্তু বিচারে দেখা যাচ্ছে, এটা ২০০৪ সালে লেখা হয়েছিল। নিবন্ধে ঘটনার পূর্বাপর বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০২ সালের অক্টোবর,নভেম্বর মাসে এবং ২০০৩ সালের শুরুর দিকে কয়েকবার এই চিতাবাঘকে গরুটার কাছে আসতে দেখা গিয়েছে। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসের পরে আর কখনো চিতাবাঘটিকে গরুটার কাছে আসতে দেখা যায়নি। কয়েকবার চিতাবাঘটিকে ফাঁদ পেতে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে,কিন্তু ধরা সম্ভব হয়নি।
গরু-চিতাবাঘ এর এমনআচরণের কারণ হিসেবে গ্রামবাসীদের বিভিন্ন ধারনার কথা উঠে এসেছে এই নিবন্ধে (যেমন,তারা পূর্ব জন্মে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত ছিল, কিংবা অলৌকিক কারণে তাদের এমন বন্ধুত্ব ঘটেছে,ইত্যাদি)। নিবন্ধের লেখক নিজে মনে করছেন, চিতাবাঘটি কমবয়সে কোনো এক দুর্ঘটনায় তার মা-কে হারায়। এর পরে গরুটির মধ্যে কোনো এক ধরণের মাতৃসুলভ বৈশিষ্ট্য দেখতে পেয়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। গরুটিও চিতাবাঘটির মধ্যে বিপজ্জনক কিছু দেখতে না পেয়ে তাকে আপন করে নিয়েছিল।
লক্ষণীয়, এই নিবন্ধেও লেখক গরুর দুধপান করা সম্পর্কিত কোনো তথ্য ,এমনকি কোনো গুজবের কথাও উল্লেখ করেননি।
তবে কয়েক বছর পরে, এই একই ছবি ব্যবহার করে কিছু গুজব ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে মূলঘটনাকে বিকৃত করে, স্থান এবং সময় পরিবর্তন করে কিছু কাল্পনিক গল্প যোগ করা হয়েছিল।
অন্যান্য ফ্যাক্টচেকারদের অনুসন্ধান
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই গুজবটা বিভিন্ন সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানিয়েছে, ঘটনাটা সঠিক নয়। গরু এবং চিতাবাঘটির মধ্যে এক ধরনের অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু চিতাবাঘটির শৈশবের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ২০০২ সালের অক্টোবরে যখন প্রথম চিতাবাঘের সাথে গরুটিকে দেখা যায়, তখন চিতাবাঘটি প্রাপ্তবয়স্কই ছিল, শিশু নয়।
ভাইরাল হওয়া ছবি গুলো সত্য। ভারতে একজোড়া গরু এবং চিতাবাঘের এমন সখ্যতার ঘটনা ঘটেছিল। তবে ঘটনার স্থান সঠিক নয়। একইসাথে, এদের সখ্যতার কারণ হিসেবে যা দাবি করা হচ্ছে, সেটাও অতিকল্পনা, এবং এর পেছনে কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নেই। সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই ভাইরাল পোস্টকে ‘আংশিক মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?