সম্প্রতি ফেসবুকে “ডেল্টা স্লিপ” বিষয়ক একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে । এখানে দাবি করা হচ্ছে, রাতের নির্দিষ্ট সময়ের ৩ ঘণ্টার বিশেষ ঘুম (ডেল্টা স্লিপ) অনেক বেশি তৃপ্তিদায়ক , এবং এই তৃপ্তি দিনের অন্য সময়ে ২০ ঘণ্টা ঘুমিয়েও পাওয়া সম্ভব না ।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ঘুমের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়কে ডেল্টা স্লিপ বলা হয়ে থাকে। তবে এটা আলাদা করে তাৎপর্যময় কিংবা তৃপ্তিময় নয়, এবং রাতের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে না।
রাত ১১ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত সময়ের ঘুমকে ডেল্টা স্লিপ বলে। এই ঘুম যদি কেউ না পায় তাহলে বাকি ২৪ ঘন্টায় ২০ ঘন্টা ঘুমালেও ঘুমের আসল তৃপ্তি পাওয়া যায় না।
আর ডেল্টা স্লিপ না পাওয়ার ফলে ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া শুরু করে।
পড়তে, খেতে এবং যেকোনো কাজ করতে আলসেমি অনূভুত হয়।❤️
–ডা. জিয়াউল হক
অনুসন্ধান : জিয়াউল হক
ভাইরাল এসব পোস্টে রেফারেন্স হিসেবে কোনো তথ্যসূত্র দেওয়া হয়নি, তবে জনৈক ডাক্তার জিয়াউল হক এর নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
সকাল টিভির এই ভিডিও তে জিয়াউল হক সম্পর্কে বলা হয়েছে , তিনি লেখক ও গবেষক, সাবেক উপ পরিচালক, মানসিক হাসপাতাল, ইউকে ।
এই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে জানা গেল, তিনি সিজদার বিজ্ঞান, ধরনির পথে পথে সহ কমপক্ষে ২৪ টি বইয়ের লেখক।
বই বিক্রির ওয়েবসাইট রকমারি ডট কমের লেখক পরিচিতিতে জিয়াউল হক সম্পর্কে লেখা হয়েছে-
মেন্টাল হেলথ্ নার্সিং, মেন্টাল হেলথ, সাইকিয়াট্রিক রিহাবিলিটেশন-এ পড়াশোনা করেছেন তিনি। সর্বশেষ ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটি থেকে মেন্টাল হেলথ, ইএমআই ও ডিমেনশিয়া ম্যানেজমেন্ট কোর্স শেষ করে ইংল্যান্ডেরই একটি বেসরকারি মেন্টাল হাসপাতালের ডেপুটি ম্যানেজার ও ক্লিনিকাল লিড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এখন লেখালিখিতেই ব্যস্ত।
এছাড়া, তার মন ও মানসিক স্বাস্থ্য বইটায় ‘লেখকের কথা’ অংশে তিনি লিখেছেন, আমি অতি সাধারন মানুষ, কোনো বিশেষজ্ঞ নই।
জিয়াউল হক এর আনভেরিফাইড ফেসবুক একাউন্ট থেকেও তার একাডেমিক লেখাপড়া সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
কাজেই এসব আলোচনা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, জিয়াউল হক কোনো এমবিবিএস ডাক্তার নন, কিংবা পিএইচডি ডিগ্রিধারী কোনো ডক্টর নন।
তবে ভাইরাল পোস্টে অনেকেই তাকে ডা. জিয়াউল হক কিংবা ড. জিয়াউল হক হিসেবে সম্বোধন করেছেন ,যেখান থেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
ঘুম এবং স্লিপ সাইকেল
ডেল্টা স্লিপ নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথমে ঘুম এবং ঘুমের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে বুঝতে হবে।
মানুষের ঘুমের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। একেক পর্যায়ে রক্তচাপ,শ্বাস প্রশ্বাস এর গতি, মস্তিষ্কের কার্যক্রম ইত্যাদি একেক রকম হয়।
এই পর্যায়গুলোকে সাধারণত Awake, N1,N2,N3,REM-এই ৫টি নামে চিহ্নিত করা হয়।
REM অর্থাৎ Rapid Eye Movement পর্যায়ে চোখের মণি নড়াচড়া করে, এবং এই পর্যায়েই মানুষ স্বপ্ন দেখে। ঘুমের অন্য ৩ টা পর্যায়কে Non-REM stage বলে এবং এদেরকে N1,N2,N3 এ ভাগ করা হয়েছে।
এই সবগুলো পর্যায়কে একত্রে স্লিপ সাইকেল বলে। একেকটা সাইকেল সাধারণত ৯০ থেকে ১২০ মিনিট স্থায়ী হয়। একবারের ঘুমে সাধারণত একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ ৪ থেকে ৫ টা সাইকেল ঘুমায়।
ঘুমের প্রথম দিকের সাইকেলে নন-রেম পর্যায়ের সময়কাল বেশি থাকে, রেম-এর কম থাকে। ঘুম যত লম্বা হয়, রেম পর্যায়ের সময় আনুপাতিকহারে তত বেশি বাড়তে থাকে।
একটা সাইকেলে সাধারনত N1 এ ৫%, N2 এ ৪৫%, N3 এ ২৫% এবং REM এ ২৫% সময় ব্যয় হয়। এদের মধ্যে N-3 অর্থাৎ Non-Rem Stage 3 ঘুমের সবচেয়ে গভীর পর্যায়। এ সময়ে কাউকে ঘুম থেকে তোলা সবচেয়ে কঠিন। এমনকি ১০০ ডেসিবল এর চেয়ে জোরালো শব্দেও এ সময়ে ব্যক্তিবিশেষের ঘুম নাও ভাঙতে পারে। এই সময়ে কাউকে জোর করে ঘুম ভাঙ্গালে কিছু সময় মাথা ব্যথার মত উপসর্গ থাকবে ।
ঘুমের এই পর্যায়ে ব্রেইন এর ইসিজি করা হলে খুব কম কম্পাঙ্কের (১ থেকে ৪ হার্জ) তরঙ্গ দেখা যায়। একে ডেল্টা ওয়েভ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এই ডেল্টা ওয়েভ এর নাম অনুসারে ঘুমের এই পর্যায়কে ডেল্টা স্লিপ কিংবা লো ওয়েভ স্লিপ হিসেবেও ডাকা হয়।
আলোচ্য ভাইরাল পোস্টে যেমনটি দাবি করা হয়েছে (রাত ১১ টা থেকে রাত ২ টার মধ্যের ঘুমকে ডেল্টা স্লিপ বলে) তার কোনো সত্যতা নেই। দিন বা রাতের যে কোনো সময় ঘুমালেই মোটামুটি ৫০/৬০ মিনিট পরেই নন-রেম তৃতীয় পর্যায়ের ঘুম শুরু হবে । এবং এটা শুধুমাত্র একবার নয়, পুরা ঘুমের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে আসবে।
অর্থাৎ, আলোচ্য পোস্টের দাবির কোনো সত্যতা নেই।
ভাইরাল এই গুজবটা নিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপ ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান এ ইমামুল হক জানাচ্ছেন,
ডেল্টা স্লিপ বলতে কি আসলেই কিছু আছে?
মূলত ঘুমের বিভিন্ন ধাপ বিদ্যমান। REM এবং NREM হচ্ছে দুইটা প্রধান ধাপ। NREM এর আবার তিনটা উপ-ধাপ আছে। তো এই তিনটা উপ-ধাপের শেষ ধাপে (NREM stage 3) ব্রেইনে ডেল্টা ওয়েভ বা স্লো-ওয়েভ নামের এক ধরনের ওয়েভ তৈরী হয়, এর রেঞ্জ ১ থেকে ৩ হার্জ। এই জন্যে অনেকে এই ধাপটাকে delta sleep বলে। অবশ্য REM ধাপেও ব্রেইনে ডেলটা ওয়েভ তৈরী হয়।
কিন্তু ডাক্তার ভদ্রলোক ডেল্টা স্লিপ বলতে আসলে এরকম কিছু বোঝায়নি।
প্রথমত, উনি একটা নির্দিষ্ট সময় বলে দিয়েছেন ডেল্টা স্লিপের জন্য, রাত ১১ টা থেকে ২ টা। কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ এরকম না। আপনি যেকোনো সময়ই গভীর ঘুমে যেতে পারেন অর্থাৎ NREM stage 3 পৌছাতে পারেন তাহলে ডেল্টা ওয়েভ তৈরী হবে। এটার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নাই।
দ্বিতীয়ত, উনি ডেল্টা স্লিপ এর জন্য তিন ঘন্টা ঘুমানোর জন্য বলেছেন। এটাও ভুল। কেননা ডেল্টা স্লিপ বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বোঝায় তার স্থায়ীত্বকাল এত বেশি না।
ঘুমের চারটি ধাপের মধ্যে ৩য় এবং সবথেকে গভীর ঘুমের ধাপকে বলা হয় ডেল্টা স্লিপ। এসময় মস্তিষ্ক কাজ খুব সামান্য করে ও দেহ নিজের ক্ষয় পূরণ করতে থাকে।
ডেল্টা স্লিপ রাতের ১১টা-২টা সময়ের সাথে সম্পর্কিত না, ঘুম শুরুর ৪০-৭০ মিনিট পর এ ধাপে পৌঁছায়।
এবাদে ডেল্টা স্লিপ ২০-৪০ মিনিট স্থায়ী হয়, ৩ ঘন্টা না।
ডেল্টা স্লিপ না পাওয়ায় বিষয় অযৌক্তিক। পর্যাপ্ত ঘুমালে ধাপে ধাপে ডেল্টা স্লিপ অবশ্যই পাবে। আর ডেল্টা স্লিপের সময় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলে এরকম ২০ ঘন্টা ঘুমিয়ে তৃপ্তি না পাওয়ার বিষয়ে কোনো বাস্তব প্রমাণনেই।
ডেল্টা স্লিপের সময় ব্যাঘাত ঘটার আলাদা ক্ষতিকর প্রভাবের তথ্য পাওয়া যায়নি, সকল ধাপের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে একই ক্ষতি হয়।
সারমর্ম
আলোচ্য পোস্ট এর দাবির পক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায় নি। ডাক্তার জিয়াউল হক এর নাম এই পোস্টের সাথে ব্যবহার করা হলেও দেখা যাচ্ছে , যে জিয়াউল হক এই কথা বলেছেন, তিনি ডাক্তার নন। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
সংশোধনী নোট :
মূল পোস্টে বলা হয়েছিল, ডা জিয়াউল হক এর ফেসবুক প্রফাইল কিংবা তার সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে একজন সচেতন পাঠক জিয়াউল হক সম্পর্কে একটি ভিডিও ফ্যাক্টওয়াচের গোচরে আনেন। এই সূত্র ধরে জিয়াউল হক সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়ার কারনে , মূল প্রতিবেদনে তার সম্পর্কে নতুন তথ্য যোগ করা হল।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?