দেওবন্দ শিক্ষকের জানাযায় জ্বিনের অংশগ্রহণ – বিভ্রান্তিকর ভিডিও

131
দেওবন্দ শিক্ষকের জানাযায় জ্বিনের অংশগ্রহণ – বিভ্রান্তিকর ভিডিও
দেওবন্দ শিক্ষকের জানাযায় জ্বিনের অংশগ্রহণ – বিভ্রান্তিকর ভিডিও

Published on: [post_published]

সম্প্রতি ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসার এক শিক্ষকের জানাযায় জ্বিনের অংশগ্রহণ বিষয়ক একটি দাবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, দু’জন ব্যক্তির হাত তাদের সামনে থাকা দু’জন মানুষকে পার হয়ে জানাযার খাটিয়া স্পর্শ করেছে। সেটার ওপর ভিত্তি করে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দু’জন ব্যক্তিকে “জ্বিন” বলে সাব্যস্ত করছেন। কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সামনে থাকা দুজনকে পার হয়ে তৃতীয় ব্যক্তির হাত সামনে পৌঁছাতে পারে, এটা অলৌকিক কিছু নয়। শুধু এই উপাত্তের ভিত্তিতে জানাযায় জ্বিন অংশ নিয়েছিল, এটা প্রমাণ হয় না। ফলে, ভাইরাল পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “বিভ্রান্তিকর” সাব্যস্ত করছে।

গুজবের উৎস

ভাইরাল কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ,এখানে , এখানে


বাংলা ভাষায় এই পোস্ট ছাড়াও অন্যান্য ভাষাতেও এই পোস্ট দেখা যাচ্ছে। এমনকি ইউটিউবেও হিন্দি এবং উর্দুতে এই ভিডিওটি দেখা যাচ্ছে।

মুহাম্মাদ রিয়াজুল ইসলাম গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ৩০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও, এবং ভিডিও থেকে নেওয়া একটি স্ক্রিনশট পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখেন,

সুবহানাল্লাহ,জানাজাতে জ্বীনের অংশগ্রহণ~

আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (নাউওরাল্লাহু মারকদাহু) এর পৌত্র শাইখ নাসীম আখতার কাইসার (রহঃ) এর জানাজা মোবারক এর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

ভিডিওটি দেখে সবাই চমকে গেছেন, দেওবন্দের শিক্ষক শাইখ ফুদ্বাইল আহমাদ হাফিঃ ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কিছু জ্বীন যারা একেবারেই সাধারণ মানুষের বেশে জানাজায় শরীক হয়েছে, প্রথমে মানুষের মতো থাকলেও কিন্তু লাশের খাটিয়া ধরার সময় তাদের হাতের নাগালের মধ্যে খাটিয়া ছিল না, তাই তাদের হাত ধীরে ধীরে বড় হতে হতে অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায় এবং তারা সেই খাটিয়া ধরে ফেলে।

সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ ওয়ালাগন যে কতটা সম্মানিত তা দুনিয়ার মানুষ আরো একবার স্বাক্ষী হয়ে রইলো।

এই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে অনেকেই এটাকে একটা অলৌকিক ঘটনা দাবি করে বিভিন্ন কমেন্ট করেন।

আবার অনেকেই এখানে জ্বিন অংশ নেয়ার দাবিকে ভুল প্রমাণ করতে বিভিন্ন যৌক্তিক ব্যাখ্যা পেশ করেন।


ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

গত ১৩ই সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরির নাতি মাওলানা নাসিম শাহের ইন্তেকাল শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এই খবরে জানানো হয়, ভারতের প্রবীণ আলেম দারুল উলুম দেওবন্দের (ওয়াকফ) মুহাদ্দিস ও গবেষক মাওলানা নাসিম আখতার শাহ কায়সার ইন্তিকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন।

রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ এলাকার নিজ বাসভবনে মারা যান তিনি। তিনি বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ:-এর নাতি।

শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সম্পাদনা ও গ্রন্থ রচনায় অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন মাওলানা নাসিম আখতার শাহ কায়সার। মহান এই আলেম ১৯৬০ সালে ২৫ আগস্ট দেওবন্দে জন্মগ্রহণ করেন।

একই খবর দেখা যায় আওয়ার ইসলাম নামক অন্য একটি ওয়েব পোর্টালে এই খবর দেখা যায়।

তবে কোনো সংবাদমাধ্যমে তার জানাযায় অস্বাভাবিক কোনো ঘটনার কথা পাওয়া যায়নি। এই খবরটা কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ছড়িয়েছে।

ফেসবুকের ভাইরাল পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এখানে কয়েকজন ব্যক্তির ‘লম্বা হাত’ দেখেই তাদেরকে ‘জ্বিন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জ্বিন (বিকল্প বানান জ্বীন , ইংরেজি বানান Djinn বা Jinn) হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থ কুরআনে বর্ণিত একটি জীব বা সৃষ্টি।  প্রাক ইসলামী যুগেও জ্বিন জাতি সংক্রান্ত বিশ্বাস অন্যান্য আরব এবং এর কাছাকাছি এলাকায় বিদ্যমান ছিল। আরবি জ্বিন শব্দটির আক্ষরিক অর্থ কোন কিছু যা গুপ্ত, অদৃশ্য, অন্তরালে বসবাসকারী বা অনেক দূরবর্তী।

‘জ্বিন’ রা মানুষের ছদ্মবেশে থাকতে পারে এবং প্রয়োজনমত হাত বা পা লম্বা করে দূরের জিনিস ছুতে পারে- এমন একটি বিশ্বাস অনেকের মাঝে প্রচলিত আছে। কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘শিউলিমালা’ গল্পগ্রন্থের ‘জ্বিনের বাদশা’ গল্পে দেখানো হয়েছে জ্বিনের বাদশার তালগাছের মত লম্বা পা থাকে। এছাড়া, আবাসিক হোস্টেলে ছদ্মবেশী জ্বীনের বসবাস এবং তার বিছানায় শুয়ে থেকেই হাত লম্বা করে টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খাওয়া কিংবা দূরের দেয়ালের সুইচ অফ করে লাইট নেভানোর গল্প বিভিন্ন জায়গায়ই শোনা যায়। । (যেমন এখানে , এখানে )

এই প্রচলিত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আলোচ্য ভিডিওতে ২ জন ব্যক্তির তুলনামূলক লম্বা হাত দেখে তাদেরকে জ্বিন বলে দাবি করা হচ্ছে এখানে।

ভিডিওর মূল উৎস সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি । অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী একে  সম্ভাব্য এডিটেড ভিডিও বলে মতামত জানালেও , মূল উৎস খুজে না পাওয়ায় একে নন-এডিটেড ভিডিও হিসেবেই বিবেচনা করা যাক।  অনুসন্ধানে বোঝা যাচ্ছে, ৩০ সেকেন্ডের মূল ভিডিওর ১৬ তম সেকেন্ড থেকে স্ক্রিনশট সংগ্রহ করা হয়েছে।

        

স্ক্রিনশট টা ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, একজন ব্যক্তি অপর দুই জন ব্যক্তির ঘাড়ের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লাশের খাটিয়া স্পর্শ করছে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তির হাত অপর দুইজন ব্যক্তির ঘাড় অতিক্রম করছে।

মানব দেহের পরিমাপ বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ,এবং হাতে কলমে অনুসন্ধান করে দেখা গেল, গড়ে একজন পুরুষের কাধ থেকে আঙুলের ডগা পর্যন্ত হাতের দৈর্ঘ ২৮ ইঞ্চি , এবং একজনের কাধ চওড়ায় ৮ ইঞ্চি । সেক্ষেত্রে খুব সহজে একজনের হাত সামনের ২ জন ,এমনকি ৩ জনকেও টপকে সামনের কোনো কিছু স্পর্শ করতে পারবে।

বিভিন্ন বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণের সময়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, কিংবা টিসিবির ট্রাকে মাঝে মাঝে খাদ্য প্রত্যাশী মানুষদের এইভাবে খাদ্যের জন্য কয়েকজনকে টপকে হাত বাড়াতে দেখা যায়। এসব ছবিতে নির্দিষ্ট একজনের হাতকে অপর এবাধিক জনের ঘাড় টপে সামনে এগুতে দেখা যায়।  এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে, এখানে, এখানে, এখানে , এখানে


পরীক্ষামূলকভাবে আমরা ৩ জন স্বাস্থ্যবান তরুণকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখেছি, একজন হাত বাড়ালে সামনের ২ জনকে অতিক্রম করে তার চেয়েও বেশি সামনে অন্য কিছু ছোঁয়া সম্ভব। বলাবাহুল্য, তারা যদি আরেকটু হীনস্বাস্থ্য হন, এবং আরো ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়াতেন, তবে তৃতীয়জনের হাত আরো দূরে পৌঁছাত।

আলোচ্য ভিডিওতে সেটাই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।  সাধারণ মানুষই এটা করতে পারছে। এই কাজের জন্য ‘জ্বিন’ হওয়ার দরকার নেই। অন্যভাবে বললে, শুধু এভাবে হাত মেলতে পারলেই কাউকে জ্বিন বলা যায় না।

এছাড়া, ছবিটা ভিন্ন অ্যাংগেল থেকে দেখলে বোঝা যায়, এই দুইজন বেশ একটু সামনে ঝুঁকে পড়েছেন। এ কারণে তাদের হাত অস্বাভাবিক লাগছে। তবে ছবিটা উলটো করে দেখলেই তাদের হাতকে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টগুলোকে ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

No Factcheck schema data available.