প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন এর নামে একটি ভুয়া উক্তি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ড কামাল হোসেন সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির এর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিচ্ছেন।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে নির্বাচনের পূর্বেও ড. কামাল হোসেন এর নামে এই ভুয়া উক্তি ভাইরাল হয়েছিল। বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নির্বাচনের তারিখ এখনো নির্ধারিত হয়নি। নির্বাচনের আচরণবিধি বা সেনাবাহিনী মোতায়েন সংক্রান্ত খুঁটিনাটি কোনো বিষয়েই এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কাজেই সেনাবাহিনী মোতায়েন বা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে কামাল হোসেন এর নামে ছড়ানো এই উক্তি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক । সাম্প্রতিক সময়ে, কিংবা ২০১৮ সালে, কখনোই ড কামাল হোসেন এমন কোনো কথা বলেছেন – এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলো “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
ভাইরাল পোস্টে “টেবিলটকইউকেহাসিনাআক্তার” লেখা একটা মনোগ্রাম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকে Table Talk Uk নামক ইংল্যান্ডভিত্তিক একটি পেজ পাওয়া যায়। সেই পেজে জনৈক হাসিনা আক্তারকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে অনলাইনে টক শো করতে দেখা যায়। উক্ত পেজ থেকে ২রা মার্চ, ২০২৩ তারিখে “সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন” শিরোনামে ফটোকার্ডটি প্রকাশ করা হয়।
ডক্টর কামাল হোসেন এর ছবি যুক্ত করে এই ফটোকার্ডে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনকে একটা পরামর্শ দিতে পারি ! নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে যদি আপনাদের ভয় লাগে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু কারার জন্যে ইসলামি ছাত্র শিবির মোতায়েন করেন । দেখবেন নির্বাচন নিরাপক্ষ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে, কারণ এদের সেনাবাহিনীর ট্রেনিং না থাকতে পারে, ইসলামি আদর্শের ট্রেনিং রয়েছে।‘
এই ফটোকার্ডের শিরোনাম হিসেবে ‘সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন’ বাক্যাংশটি ব্যবহার করা হয়েছে।
এই ফটোকার্ড বাদেও অন্যান্য ফরম্যাটে (অর্থাৎ স্ট্যাটাস, পোস্টার কিংবা ভিডিও) ড কামাল হোসেন এর এই বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি ফেসবুকে ভাইরাল হতে দেখা যায়।
২০১৮ সালের এমনই ভাইরাল কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ।
ফ্যাক্টওয়াচেরঅনুসন্ধান
গণমাধ্যমে ড. কামাল হোসেন এর সাম্প্রতিক বক্তব্য ও বিবৃতি অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান-কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করায় গভীর উদ্বেগ ও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ৩০শে মার্চ, ২০২৩ তারিখে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তবে সেখানে কোথাও তিনি সেনাবাহিনী বা ছাত্রশিবির নিয়ে কিছু বলেননি।
তাছাড়া Table Talk Uk নামক যে পেজ থেকে কামাল হোসেনের বক্তব্যটি ছড়িয়েছে সেখানেও কামাল হোসেনকে সাম্প্রতিক কোন টক শো বা সাক্ষাতকারে অংশ নিতে দেখা যায়নি।
২০১৯ সালের ২৫শে মার্চ জাগো নিউজ “সঞ্চালনায় সাবেক শিবির সভাপতি, বক্তব্যে ড. কামাল” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রচার করে। উক্ত সংবাদ থেকে জানা যায় নিউজিলান্ডের ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে ড. কামাল হাসান সভাপতির বক্তব্য রাখেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জুর অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। সেখানে আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার জন্য হিংসা করা উচিত নয়। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করা যাবে না। মানুষের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা যায় না। এটা সারা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। বৈষম্য হলো নীতি, ঐতিহ্য ও ধর্মের পরিপন্থী। এ মূল্যবোধ জাগ্রত করেই এবারের স্বাধীনতা দিবস পালনের আহ্বান জানান তিনি।
তবে কামাল হোসেন কোথাও ভাইরাল হওয়া আলোচ্য বক্তব্যটি করেননি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়।
যেহেতু ড. কামাল হোসেন এর নামে এই বক্তিব্য ২০১৮ সালেও ভাইরাল হয়েছিল , তাই আমরা ২০১৮ এর নির্বাচনের পূর্বে গণমাধ্যমে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যগুলো অনুসন্ধানের চেষ্টা করি ।
২৩শে ডিসেম্বর, ২০১৮ তারিখে বাংলা ট্রিবিউন প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা যাচ্ছে কামাল হোসেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সেনাবাহিনী মোতায়েনকে স্বাগত জানিয়েছেন।ড. কামাল হোসেন বলেন “আমরা আশা করি সেনা মোতায়েন দেশে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যা এ পর্যন্ত অনুপস্থিত রয়েছে।” এ সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে কামাল হোসেন সেনাবাহিনীতেই ভরসা রাখছেন, এবং সেনাবাহিনীর বিকল্প কোনো বাহিনীর কথা প্রথাব করছেন না।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম ঐক্যফ্রন্ট জোটের হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ঐক্যফ্রন্ট জোটটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এই ছয়টি সদস্য দল নিয়ে গঠিত হয়। অর্থ্যৎ ঐক্যফ্রন্ট জোটে জামায়েতে ইসলাম ছিলো না।
২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে ৭ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী দল একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে একটি আলোচিত সমালোচিত দল। তাছাড়া ড. কামাল হোসেনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে খ্যাতিমান একজন রাজনীতিবিদ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কমিটির তিনি ছিলেন চেয়ারম্যান। রাজনৈতিক দিক থেকে ছাত্র শিবির এবং ড. কামাল হোসেনের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। তাই কামাল হোসেন জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবির নিয়ে প্রকাশ্যে কোন মন্তব্য করলে তা গণমাধ্যমে আসবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে “সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন”- ড. কামাল হোসেনের এমন কোন মন্তব্য কোন গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি। কেবলমাত্র ফেসবুকেই এই বক্তব্যটা ভাইরাল হয়েছে।
সার্বিক আলোচনা থেকে বলা যায় ভাইরাল হওয়া বক্তব্যটি ড. কামাল হোসেন দিয়েছেন এমন কোন প্রমাণ ফ্যাক্টওয়াচ এর অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?