যা দাবি করা হচ্ছে: মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো বৈধ করেছেন, এবং নির্দিষ্ট একটি ক্যাসিনোর ওয়েবসাইটে সবাইকে খেলার আহবান জানাচ্ছেন।
যা পাওয়া যাচ্ছে: ড. ইউনূসের ভিন্ন একটি ভাষণকে কাটছাঁট করে, এবং অন্যের কণ্ঠ আরোপ করে এই ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার অনলাইন ক্যাসিনো বৈধ ঘোষণা করেনি, এবং ড. ইউনূস কোনো বিজ্ঞাপনে তাঁর ছবি ব্যবহার না করার অনুরোধ করেছেন।
এসব পোস্টে ২৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সংযুক্ত করা রয়েছে ।ভিডিওতে একজন সংবাদ পাঠিকাকে বলতে শোনা যায়, মুহাম্মদ ইউনূস এখন অনলাইন ক্যাসিনোগুলি বৈধ করেছেন এবং জয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এরপরের ফ্রেমে দেখা যায় , ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলছেন, আমি বাংলাদেশের সব বাসিন্দাদের কাছে সাহায্য করব যাতে তারা বিপন্নতা থেকে বের হতে পারে এবং প্রথম এক লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারে। অবরোধের পরে অনেকের কাছ থেকে অর্থ এবং কাজ ছিল না। আমি একটি নতুন ক্রেজি টাইম এ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছি যেখানে সব জয় নিশ্চিত হই মাসে । যারা প্রতিবাদের প্রভাবে আক্রান্ত হয়েছে,তাদের জন্য ১০০০ শতাংশ বোনাস প্রদান করা হবে।কিছু বাজি করুন এবং জয় নিশ্চিত। আমার কাছ থেকে বোনাস পেতে ডাউনলোড করুন এবং লাভ করুন।
এই ভিডিওর মাঝে Crazy Times নামক একটি অনলাইন ক্যাসিনো ওয়েবসাইট বা এ্যাপ এর নাম,লোগো, প্রোমো ইত্যাদিও দেখানো হয়।
অনুসন্ধান
ভিডিওর প্রথম ফ্রেমে সময় টিভির লোগো দেখা যাচ্ছে। তবে স্ক্রিনের অন্য অংশের লে আউটের সাথে সময় টিভির লে আউট মিলছে না।
সময় টিভির ইউটিউব চ্যানেল থেকে দেখা যাচ্ছে, সময় টিভির লোগোটা থাকে স্ক্রিনের ডান পাশে ( ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে লোগোটি স্ক্রিনের বাম পাশে)। এছাড়ালোগোর উপরে নিয়মিতভাবে সময় দেখানো হয়, যা ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে অনুপস্থিত। সংবাদ শিরোনামের আঙ্গিক এবং ফন্টেও রয়েছে পার্থক্য। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, এটি সময় টিভির কোনো ফ্রেম নয়, বরং এডিটেড ছবি।
এছাড়া, ভিডিওতে দেখানো সংবাদ উপস্থাপনের সেট এর সাথে RTV এর সেট এর সাদৃশ্য লক্ষ করা যাচ্ছে, যদিও স্ক্রিনের বাম অংশ সুচারুভাবে কর্তন করা হয়েছে ( এই অংশে আরটিভি এর লোগো থাকে)। অবশিষ্ট অংশে দৃশ্যমান উপস্থাপিকার সাজ সজ্জার ( শাড়ি, ব্লাউজ, গলার অলংকার, চুলের বিন্যাস ইত্যাদি) সাথে আরটিভিতে ২৯শে এপ্রিল এর সন্ধ্যার সংবাদের অন্যতম সংবাদ উপস্থাপিকা , সৈয়দা সাদিয়া বেনজীর এর সাজসজ্জা পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। তবে এদিনের সন্ধ্যার সংবাদে মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কিত কোনো খবর শুনতে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া, এই ভিডিওতে ড ইউনূসের পোষাক ও অলংকৃত চেয়ারের সাথে হুবহু মিল দেখা যাচ্ছে ৮ই আগস্ট তারিখে বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণের সময়কার সাজসজ্জার সাথে। এই ভাষণে ক্রেজি টাইম বা অনলাইন ক্যাসিনো সংক্রান্ত কোনো শব্দ ড. ইউনূস উচ্চারণ করেননি।
এই দুটি ভিডিওর সাথে আরো কিছু ভিডিও যোগ করে মূল শব্দ বর্জন করে নতুন শব্দ যোগ করে এই ২৮ সেকেন্ডের ভিডিও প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ভিডিওর এক স্থানে Crazy Time নামক একটি এ্যাপ এর বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেল, এটি একটি অনলাইন ক্যাসিনো ,বা জুয়া খেলার ওয়েবসাইট।
গত ২রা জুলাই মানবজমিনে প্রকাশিত ‘জুয়ার শাস্তি ২০০ টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ১৫৭ বছর আগের জুয়া আইনেই চলছে জুয়া প্রতিরোধ কার্যক্রম। এই আইনে সর্বোচ্চ জরিমানা রয়েছে মাত্র ২০০ টাকা। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় এই আইনটির অকার্যকারিতার বিষয়টি সামনে আসে। তখন সারা দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। অনেককে আটক করা হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে জুয়া আইনে মামলা করা হয়নি। করা হয়েছে অন্য আইনে। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে দেড়শ’বছরের অধিক পুরনো জুয়া আইনের সংশোধন অথবা জুয়া প্রতিরোধে নতুন আইন করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি তা আমলে নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এসপি মো. নাজমুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এখন অফলাইনের চেয়ে অনলাইনে জুয়া খেলায় মত্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ১৮৬৭ সালের জুয়া আইনে অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনোর বিষয়টি উল্লেখ নেই। এটা আরেকটি সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য জুয়া আইনে অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনোর বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে সাজা ও জরিমানার পরিমাণ যুগোপযোগী করতে হবে। জুয়া আইনে কার্যকর ধারা না থাকায় জুয়াড়িরা এই সুযোগে বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।
২০২৩ সালে জুয়া আইনটিকে যুগোপযোগী করার জন্য একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। উদ্যোগের অংশ হিসেবে ‘জুয়া আইন ২০২৩’ এর খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ করলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি আইনটি।
এই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে , বাংলাদেশের বর্তমান আইনে ‘অনলাইন ক্যাসিনো’ নিয়ে সরাসরি কোনো আইন নেই, তবে সরকার এই ‘অনলাইন ক্যাসিনো’ বন্ধ করার জন্য আইন প্রনয়ণের চেষ্টা করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড ইউনূসের বরাতে ‘সরকার অনলাইন ক্যাসিনো বৈধ করার উদ্যোগ নিয়েছে’ এমন দাবি অবান্তর।
এছাড়া গত ৯ই আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন বা অন্য কোনো প্রচারণায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে ক্রেজি টাইম নামক এই অনলাইন ক্যাসিনোটি নিশ্চিতভাবেই ড. ইউনূসের অনুমতি ব্যাতিরেকে এবং অবৈধভাবে তাঁর ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে।
সিদ্ধান্ত
সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ অনলাইন ক্যাসিনো বৈধ করার ভুয়া সংবাদযুক্ত এ সকল পোস্টকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।