শব্দের চেয়ে আলোর গতি বেশি হওয়ায় বজ্রপাতের আলোর ঝলকানি আমরা আগে দেখতে পাই এবং পরে তার বিকট শব্দ শুনি৷ ক্যামেরায় লং এক্সপোজার দিয়ে শাটার স্পিড কমিয়ে বজ্রপাতের মূহুর্তটিকে যখন ধারণ করা হয় তখন দৃশ্য আরও দারুণভাবে ফুটে উঠে। এবার ঠিক এমনই একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। “গাছে বাজ পড়ার এই অবিশ্বাস্য মূহুর্ত ক্যাপচার করেছেন ফটোগ্রাফার ড্যারেন পিয়ারসন” – দাবিতে ছবিটি শেয়ার করা হচ্ছে। তবে স্বয়ং পিয়ারসনই জানিয়েছেন, ছবিটি তিনি তুলেন নি! বরং গাছের উপর বাজ পড়ার ছবিটি তিনি দুটো পৃথক ছবির সমন্বয়ে সম্পাদনা করে তৈরি করেছেন। গাছের ছবিটি তার নিজের তোলা এবং বজ্রপাতের ছবিটি তিনি নাসা’র একটি ওয়েবসাইট থেকে নিয়েছেন। এইসকল তথ্য ড্যারেন পিয়ারসন ‘স্নোপস’ নামক একটি তথ্য-যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছেন। পিয়ারসনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে তিনি মূলত লাইট পেইন্টিং ব্যবহার করে ছবি তুলেন এবং গাছে বাজ পড়ার ছবিটি তার একটি নমুনা। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির দাবিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।
অনুসন্ধান:
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিটি সঠিক কিনা তা যাচাই করতে আমরা উক্ত ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করি। আমাদের অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক তথ্য-যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্নোপস’ এর একটি ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া গেছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে ড্যারেন পিয়ারসন নামক একজন ফটোগ্রাফার গাছে বাজ পড়ার একটি অবিশ্বাস্য মূহুর্ত ধারণ করেছেন! এখন গাছে বাজ পড়ার ছবি তোলা একজন ফটোগ্রাফারের জন্য অসম্ভব কিছু নয়। সেজন্য প্রয়োজন অসীম ধৈর্য্য। তবে, গাছে বাজ পড়ার যে ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি ড্যারেন পিয়ারসন তুলেন নি। তাহলে ছবিটি কিভাবে এলো? এই ব্যাপারে স্বয়ং পিয়ারসনই স্নোপেসকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বিশদভাবে বলেছেন। প্রথমত, গাছে বাজ পড়ার এই ছবিটি দুটো পৃথক ছবির সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পিয়ারসন গাছের ছবিটি লাইট পেইন্টিং ব্যবহার করে নিজেই তুলেছিলেন এবং বজ্রপাতের ছবিটি নাসা’র একটি ওয়েবসাইট থেকে নিয়েছিলেন।
Photo credit: Snopes
ছবিটি প্রসঙ্গে পিয়ারসন আরও বলেন, গাছের উপর বাজ পড়ার ছবির আইডিয়াটা ছিল তার রুমমেট জোয়ি’র এবং বজ্রপাতের ছবিটি সংযোজন করার পর দেখা গেল সেটি আসলেই দারুণ দেখাচ্ছে। পিয়ারসন কখনোই চাননি যে গাছের উপর বাজ পড়ার ছবিটিকে কেউ আসল ভাবুক। বরং সে এটিকে একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন৷ কিন্তু মানুষ তার এই চাওয়ার থোড়াই কেয়ার করলো। এটিকে বাস্তব ছবি হিসেবেই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিলো!
ড্যারেন পিয়ারসনের ছবিটিকে যারা আসল ছবি ভেবে ছড়িয়ে দিলেন তাদের কিছু নমুনা দেখবেন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে।
Example of the viral photo
এরপর আমরা কৌতুহলবশত ড্যারেন পিয়ারসনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটটি ঘুরে দেখলাম। সেখানে তিনি তার লাইট পেইন্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করে তোলা বিভিন্ন ছবি বিক্রির জন্য প্রদর্শনীতে রেখেছেন। গাছে বাজ পড়ার ছবিটি তার সেইসকল কাজের একটি নমুনা। এখানে লাইট পেইন্টিং নিয়ে সামান্য কিছু জানিয়ে রাখাটা যুক্তিসঙ্গত হবে। লাইট পেইন্টিং হচ্ছে একটি ফটোগ্রাফিক টেকনিক, যেখানে ক্যামেরায় লং এক্সপোজার দিয়ে একটি আলোর উৎস হাতে নিয়ে কোনকিছু আঁকার ভঙ্গিতে সেটিকে বিভিন্ন দিকে নাড়ানো হয় এবং ফলাফল হিসেবে ফটোগ্রাফার তার মনোমত একটি ছবি পান। একটা উদাহরণ দেয়া যাক: ধরুন, আপনি একটি লম্বা দেয়ালের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হাতে লাল বর্ণের আলোর উৎস নিয়ে দৌড়ে যাবার ছবি তুলছেন এবং ক্যামেরায় লং এক্সপোজার দিয়ে শাটার স্পিড কমিয়ে রাখা হয়েছে। ফলাফল আসবে, দেয়ালের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত লম্বা একটি লাল আলোর রেখা! এভাবে ফটোগ্রাফাররা লাইট পেইন্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করে তাদের শৈল্পিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন।
অতএব, এতক্ষণে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, গাছে বাজ পড়ার ছবিটি কোন আসল ছবি নয়। বরং সেটি দুটো পৃথক ছবির সমন্বয়ে বানানো ফটোগ্রাফার ড্যারেন পিয়ারসনের একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি।
তাই এইসকল তথ্য বিবেচনা সাপেক্ষে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিকে বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।