“ট্রেন আসার সময় সৃষ্ট তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে রেললাইনে কোন গাড়ি উঠলে তখনই তার ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়” এই দাবিতে কিছু পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে সম্প্রতি মিরসরাই এ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর। অনুসন্ধানে দেখা গেছে এই দাবিটি যুক্তিযুক্ত নয়। এমনকি পোস্টগুলোতে যেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে দাবিটি প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। সুতরাং ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিটিকে মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করছে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:
এ বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে অনুসন্ধান করা হলে দেখা যায় এমন একটি মনগড়া মিথ্যা দাবি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত রয়েছে। সেখানে বলা হয়ে থাকে যে, যখন ট্রেন লেভেল ক্রসিং এর প্রায় কাছাকাছি চলে আসে অর্থাৎ সীমার মধ্যে এসে যায়, তখন লাইনের মধ্যে চাকার ঘর্ষণের ফলে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তি তৈরি হয়। এ কারণে পুরো রেল লাইন আবিষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে সে সময়ে লাইনে অন্য কোন গাড়ি উঠলে সাথে সাথে তার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে গাড়িটি অনেক সময় রেল লাইন থেকে সরে যেতে পারে না। কিন্তু এটি একটি ভুল ব্যাখা এবং এটিকে একেক সময় একেক বিজ্ঞানী অথবা পদার্থবিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা বলে প্রচার করা হয়।
বর্তমানে ভাইরাল পোস্টে পদার্থবিজ্ঞান অধ্যাপক বলরাম ভৌমিক এর নামে এই দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এই নামের অন্য কোন অধ্যাপকের তড়িৎ চুম্বক বিষয়ে কোন গবেষণাপত্র বা প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়নি ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে। অনুসন্ধানে আমরা এই নামে সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজের একজন পদার্থবিজ্ঞান এর এক অধ্যাপককে খুঁজে পাই। তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফ্যাক্টওয়াচকে জানান, তিনি জনসমক্ষে বা নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে এরকম কোন দাবি করেননি। হয়তো কোন ব্যক্তিগত আলোচনায় এরকম কিছু বলে থাকতে পারেন, কিন্তু তা শুধুই তার নিজের ধারণা। যেহেতু তিনি জনসমক্ষে এরূপ কোন ব্যাখ্যা দেননি অথবা দাবি করেননি, তাই এর কোন দায়ভার তিনি নেবেন না।
প্রচলিত এই দাবিটি এর আগে এ বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের নামেও প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দাবিরও কোনো সত্যতা ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে পাওয়া যায় নি।
দাবিটির সত্যতা যাচাই-বাছাই করতে একাধিক বিজ্ঞান ও রেল যোগাযোগ বিষয়ক প্রবন্ধ পড়ে ফ্যাক্টওয়াচ জানতে পেরেছে যে, প্রচলিত দাবিটি মিথ্যা। সেসব থেকে জানা যাচ্ছে, কেবলমাত্র পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে যদি কোনো তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়, সেটি কোনো গাড়িকে কখনো কখনো নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা রাখে। তবে সাধারণত গাড়ির ইঞ্জিনকে তড়িৎ চৌম্বকক্ষেত্র প্রতিরোধী হিসেবেই বানানো হয়। রেললাইনে রেলগাড়ি আসার সময় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় না, যা কোন গাড়ির ইঞ্জিন বিকল করে দিতে পারে। এই চৌম্বকক্ষেত্রটি এতটাই দূর্বল যে, এটিএমন কি কোন কম্পাসের সুঁচকে নড়ানোর ক্ষমতা রাখে না।
সাধারণ ট্রেনের চাকার ঘর্ষণে রেলপথে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয় না। দুটো ধাতুর ঘর্ষণে যদি কম্পণ সৃষ্টি হয় সেক্ষেত্রে কোনো একটি ধাতু যদি আগে থেকে চার্জড (আহিত) থাকে, তখনই কেবল সামান্য মাত্রার তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে।যেমন ম্যাগলেভ ট্রেন, ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ট্রেনের ক্ষেত্রে ঘটে।তাও যে মাত্রার তরঙ্গ সৃষ্টি হবে তা কখনই একটি গাড়ির ইঞ্জিনকে থামিয়ে দেওয়ার মত শক্তিশালী নয়।
এই ভুয়া দাবিটি মিথ্যা প্রমাণ করে এর আগে শিকাগো সান টাইমসের একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছিল। সেটিতেরেললাইন পার হওয়ার সময়ের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত কারণগুলো সনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-
গাড়িতে আগে থেকেই যান্ত্রিক সমস্যা থাকার জন্য রেললাইন দ্রুত পার হওয়ার সময়
ঝাঁকিতে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তবে ঐ সাড়ে পাঁচ হাজারে মাত্র ৬টি এরূপ দুর্ঘটনা ছিল যেখানে গাড়ির ইঞ্জিন রেললাইনে বন্ধ হওয়াতে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রেললাইন অতিক্রম করার সময় গাড়ি থেমে গেলে ট্রেন আসার কথা চিন্তা করে গাড়ির চালক অনেকক্ষেত্রে আতংকিত হয়ে পড়ে এবং পুনরায় ইঞ্জিন চালু করতে ব্যর্থ হয়।
তথ্যসম্ভার অনুযায়ী প্রায় চার ভাগের এক ভাগ এরকম দূর্ঘটনার কারণ হচ্ছে গাড়িরচাকা, প্লেট, বাম্পার কিংবা আনুষঙ্গিক অন্যান্য পার্ট লাইনে আটকে যাওয়া।
গুজবটাতে আরো বলাছিল- ” রেললাইনের উপরে জ্যান্ত মানুষ থাকা অবস্থাতেও ম্যাগনেটিক ফোর্স এর কারণে সে আটকে যাবে”। এটা সম্পূর্ণ ভুল। ম্যাগনেটিক ফোর্স শুধুমাত্র লোহা কিংবা নিকেল এর মত চৌম্বকীয় পদার্থকেই আকর্ষণ করে। মানব শরীরকে করবে না।
অতএব, আমরা এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে এই ভাইরাল দাবিটিতড়িৎচুম্বক এবং অটোমোবাইল কোনো বিষয়থেকেই বৈজ্ঞানিক অনুমান দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে না। এমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় নি।তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিটিকে মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?