সম্প্রতি “সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে নকল ডিম, জেনে রাখুন বিষাক্ত ডিম চিনে নেয়ার ১০টি লক্ষণ” শিরোনামে একটি খবর ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। মূলত এই খবরগুলো ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত হয়ে আসছে। বাস্তবে খবরটি প্রায় ৭ বছরের পুরনো। এতে বাংলাদেশে নকল বা কৃত্রিম ডিম পাবার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে, নকল ডিম বানানোর পক্ষে আজ পর্যন্ত কোনো যুক্তি পাওয়া যায় নি, বরং বিভিন্ন সময়ে বৈজ্ঞানিকেরাই এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। সব বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই সংবাদগুলোকে ভূয়া সাব্যস্ত করছে।
সংবাদগুলোতে বলা হচ্ছে, “আক্ষরিক অর্থেই চিন (চীন) থেকে বিপুল পরিমাণ নকল ডিম ছড়িয়ে পড়ছে ভারত-বাংলাদেশে-মায়ানমার সহ আশেপাশের অনেক দেশে।“ উক্ত সংবাদগুলো সূত্রে নকল ডিম চেনার বৈশিষ্ট্য গুলো হচ্ছে:
– কৃত্রিম ডিম অনেক বেশি ভঙ্গুর। এর খোসা অল্প চাপেই ভেঙে যায়। এই ডিম সিদ্ধ করলে কুসুম বর্ণহীন হয়ে যায়। ভাঙার পর আসল ডিমের মতো কুসুম এক জায়গায় না থেকে খানিকটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
– অনেক সময় পুরো কুসুমটাই নষ্ট ডিমের মত ছড়ানো থাকে। কৃত্রিম ডিম আকারে আসল ডিমের তুলনায় সামান্য বড় । এর খোলস খুব মসৃণ হয়। খোসায় প্রায়ই বিন্দু বিন্দু ফুটকি দাগ দেখা যায়।
-রান্না করার পর এই ডিমে অনেক সম্যেই বাজে গন্ধ হয়। কিংবা গন্ধ ছাড়া থাকে। আসল কুসুমের গন্ধ পাওয়া যায় না। নকল ডিমকে যদি আপনি সাবান বা অন্য কোন তীব্র গন্ধযুক্ত বস্তুর সাথে রাখেন,
– ডিমের মাঝে সেই গন্ধ ঢুকে যায়। রান্নার পরেও ডিম থেকে সাবানের গন্ধই পেতে থাকবেন।
– নকল ডিমের আরেকটি লক্ষণ হলো ডিম দিয়ে তৈরি খাবারে এটা ডিমের কাজ করে না। যেমন পুডিং বা কাবাবে ডিম দিলেন বাইনডার হিসাবে। কিন্তু রান্নার পর দেখবেন কাবাব ফেটে যাবে, পুডিং জমবে না।
– নকল ডিমের আকৃতি অন্য ডিমের তুলনায় তুলনামূলক লম্বাটে ধরণের হয়ে থাকে।
– নকল ডিমের কুসুমের চারপাশে রাসায়নিকের পর্দা থাকে বিধায় অক্ষত কুসুম পাওয়া গেলে সেই কুসুম কাঁচা কিংবা রান্না অবস্থাতে সহজে ভাঙতে চায় না।
এই তথ্যটি ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে,এখানে এবং এখানে। সংবাদগুলোতে সম্প্রতি “নকল ডিম পাওয়া গিয়েছে” এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। খবরটিতে বলা হয়েছে, “খোদ বাংলাদেশেই নকল ডিম কেনার ও খাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকের হয়েছে। এবং আক্ষরিক অর্থেই চিন থেকে বিপুল পরিমাণ নকল ডিম ছড়িয়ে পড়ছে ভারত-বাংলাদেশে-মায়ানমার সহ আশেপাশের অনেক দেশেই।“ ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদমাধ্যমে এমন কোনো সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘দ্য ইন্টারনেট জার্নাল অব টক্সিকোলজি’ এ নকল ডিম নিয়ে প্রতিবেদনটি ‘ভুল করে প্রকাশ করা হয়েছিল’!
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ইন্টারনেট জার্নাল অফ টক্সিকোলজি’তে কৃত্রিম ডিম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে বলে দাবি করছে এসব ভাইরাল খবরগুলো। ফ্যাক্ট-চেকিং সাইট যাচাই এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করে। তাদের প্রতিবেদনসূত্রে জানা গেছে, আলেকজান্ডার লি-র লেখা ঐ প্রবন্ধটি মূলত বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্লগ ও রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বানানো ছিল, কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে তা লেখা হয় নি। পরবর্তীতে জার্নাল কর্তৃপক্ষ জানায় যে প্রবন্ধটি ‘ভুল করে প্রকাশ করা হয়েছে’ এবং এটি তারা সরিয়ে দেয় তাদের জার্নাল থেকে।“ “Faked Eggs: The World’s Most Unbelievable Invention” শিরোনামে আলেকজান্ডার লি-র প্রবন্ধের আরকাইভ ভার্সনটি দেখুন এখানে। দ্য ইন্টারনেট জার্নাল অফ টক্সিকোলজি সম্পর্কেও ফ্যাক্টওয়াচ খোঁজখবর নিয়েছে। এই জার্নালটি কোনো বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে কোনো স্বীকৃত জার্নাল নয়। বরং Bealls এর প্রিডেটরি বা প্রতারক জার্নালের লিস্টে এই জার্নাল প্রকাশকের নাম পাওয়া গেছে। দেখুন এখানে।
বাংলাদেশে ‘নকল’ ডিম সংক্রান্ত অন্যান্য প্রতিবেদন খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ২৮ জুলাই, ২০১৭ তারিখে বোয়ালখালী আদালতের এক বিচারকের করা অভিযোগের ভিত্তিতে নকল সন্দেহে ৩ হাজার ডিম জব্দ করেছিল পটিয়া থানা পুলিশ। পরদিন ওই জব্দ ডিমগুলো পরীক্ষার জন্য পুলিশ আদালতে আবেদন করছিল। পরবর্তীতে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষায় ডিমগুলো আসল প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো নকল ডিম নয়।
“প্লাস্টিকের ডিম কিভাবে তৈরি করে দেখুন।“ ক্যাপশনে একটি ভিডিও বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক এবং ইউটিউবে ভাইরাল হতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে ৪ মে ২০১৮ তারিখে observers.france24.com এর একটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাস্তবে, ভিডিওটি দৃশ্যমান বস্তুগুলো প্লাস্টিকের নকল ডিম নয়, একে “স্লাইম” বলা হয় যা মূলত বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি বাচ্চাদের খেলনা।
এছাড়াও, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মূলধারার কিছু সংবাদমাধ্যমকে ফলাও করে “নকল ও আসল ডিম চেনার উপায়” নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে দেখা যায়। যদিও এই প্রতিবেদনগুলোতে কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত কিংবা তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশের বাজারে ‘নকল’ ডিম পাবার প্রমাণ না পাওয়া গেলেও উক্ত প্রতিবেদনগুলোর প্রচার ও উপস্থাপন পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে,এখানে এবং এখানে।
নকল বা প্লাস্টিকের ডিম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?
কোন প্রযুক্তি বা রাসায়নিক দ্রব্য এখন পর্যন্ত মেলেনি যা দিয়ে সম্পূর্ণভাবে ডিম উৎপাদন করা যায়। এছাড়াও, এটি অর্থনৈতিকভাবে কোনো টেকসই প্রক্রিয়া নয় কারণ স্বাভাবিক ডিম সাশ্রয়ী মূল্যে এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
ডিমের পুরু খোসা ঝিল্লি ডিমের সতেজতাকে নির্দেশ করে। যখন ডিম টাটকা থাকে তখন বাষ্পীভবনের জন্য ২ টি ঝিল্লি (বাইরের এবং ভিতরের স্তর) আলাদা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না যার ফলে এটি একে অপরের সাথে লেগে থাকে। খোসা ছাড়ানোর সময় তাই এটিকে ঘন এবং শক্তিশালী দেখায়। এছাড়াও, ডিমের অভ্যন্তরীণ খোসার ঝিল্লি ১৫ দিনের বেশি বয়স হলে শক্ত এবং ভঙ্গুর হতে পারে, যা স্বাভাবিক।
প্রতিটি ডিম একে অপরের থেকে আলাদা হওয়ার কারণ হল পাখির খাবারের খাবারের গুণমান, মুরগির প্রজাতি, ডিমের বয়স এবং ডিম রক্ষণাবেক্ষণের তারতম্যের কারণে।
ডিমের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিমের সাদা অংশ তার ধারাবাহিকতা পরিবর্তন করে। এটি ধীরে ধীরে পাতলা এবং তরলীকৃত হয় এবং পরিশেষে ডিমের কুসুম এবং সাদা অংশ একে অপরের মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে যায়। এই মিশ্রণ তাপমাত্রার অপব্যবহারের কারণে বেড়ে যায়, ডিম কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়ার কারণে নয়।
প্লাস্টিকের ডিম সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি পড়ুন এখানে।
নকল ডিম সম্পর্কে কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন বলেন,“বাংলাদেশের বাজারে একটা ডিমের দাম ৮ টাকার মতো। এখন ভেবে দেখুন, একটা নকল ডিম বানাতে যা লাগে (যেমন- ডিমের শেল প্যারাফিন, জিপসাম গুঁড়া, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, এবং অন্যান্য উপকরণ) সেটা কয়েক হাজার মাইল দূর চীন থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করার খরচসহ ৮ টাকার কমে কি দেয়া সম্ভব?
দোকানি আপনার কাছে ৮ টাকায় একটা ডিম বিক্রি করলে অবশ্যই লাভ রেখে বিক্রি করছে। কাজেই তার কেনা দাম ৮ টাকার অনেক কম। তাই হিসাবটা কি মিলে? দুনিয়ার সব ডিম ব্যবসায়ীরা কি অনেক টাকা লস দিয়ে নকল ডিম বিক্রি করবেন, যেখানে আসল ডিম সস্তায় মুরগির কাছ থেকে পাওয়া যায়? অর্থনীতির হিসাব বলছে, সেটাও সম্ভব না।
কৃত্রিম ডিমের ক্ষেত্রে, ডিমের শেল প্যারাফিন, জিপসাম গুঁড়া, ক্যালসিয়াম কার্বনেট এবং অন্যান্য উপকরণ দ্বারা তৈরি করা যেতে পারে। ডিমের সাদা অংশ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে ক্যালসিয়াম আলজেনাইট দ্বারা।
সুতরাং এটা পরিষ্কার কৃত্রিম ডিম তৈরি করার জন্য অনেকগুলো রাসায়নিক প্রয়োজন এবং রাসায়নিকগুলোর সঠিক অনুপাতও জরুরি। বাজারে আমরা যে দামে ডিম পাই, এই দামের মধ্যে কখনোই কৃত্রিম বা নকল ডিম তৈরি সম্ভব না। পাশাপাশি খাবারের সময় ডিম ওমলেট বা সিদ্ধ করলে যে স্বাভাবিক আকার আকৃতি হওয়ার কথা প্লাস্টিকের ডিমে সেটা কখনোই হবে না।
আগেই বলেছি, পানিতে প্লাস্টিক সিদ্ধ হয় না। প্রয়োজনে আপনিও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সুতরাং প্লাস্টিকের চাল বা কৃত্রিম ডিম এসব গুজবে আমাদের কান না দেয়াই উত্তম।“
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের একটি অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান তালাশ এর ১০৫ তম পর্বের নাম ছিল “ডিম সমাচার”। সেই পর্বে দেখানো হয়েছিল, বিভিন্ন জায়গা থেকে ডিম সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করার পরেও কোনো নকল ডিমের নমুনা পাওয়া যায়নি। সেই পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক, অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, “ডিমটা পুরনো হয়ে গেলে কিন্তু একসময় দেখবেন যে ডিমটা ভাঙ্গলে নতুন ডিমের সাদা অংশ যেমন শক্ত থাকে, সেটা কিন্তু আর থাকে না। সেটি ছেড়ে দেয়। আবার ডিমের কুসুমটিও ভাঙ্গার পর চট করে ছড়িয়ে যায়। এটি ডিমের ‘শেলফ লাইফ’ থেকে আরও পুরনো হয়ে গেলে ডিমটা ওরকম হয়ে যায়।“
সাভারের বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আতাউল গনি রব্বানি দীর্ঘদিন ধরে এই ‘নকল ডিম এর গুজব’ এর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৭ সালের ৮ই অক্টোবর তিনি তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, ” কেউ যদি বহুলআলোচিত ১টি ‘নকল ডিম’ দিয়ে আমার গবেষণা কাজে সহযোগিতা করতে পারে, তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাকে ৫০০০/- পুরস্কৃত করবো ”
তবে এখনো পর্যন্ত কেউ নকল ডিম নিয়ে পুরষ্কার দাবী করতে আসেনি।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জাদুকর জুয়েল আইচ ও ২০১৯ সালে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন, কেউ যদি চীন থেকে আমদানি করা নকল ডিম দেখাতে পারে, তাহলে তাকে এক লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।
বলাবাহুল্য , এখনো কেউ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেনি।
উপরোক্ত তথ্যপ্রমাণ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে, সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া খবরগুলো প্রায় ৭ বছরের পুরনো যেখানে বাংলাদেশে নকল বা কৃত্রিম ডিম পাবার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ নেই। পুরনো খবরগুলো ডিমের ভোক্তাদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে পোলট্রি শিল্পের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ খবরটিকে “মিথ্যা” সাব্যস্ত করেছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?