সম্প্রতি “প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিম ২০২৪” নামক একটি ওয়েবসাইটের লিংক সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। লিংকটিতে প্রবেশ করলে ফ্রি ল্যাপটপের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে একটি ফরম পূরণ করার মাধ্যমে নিবন্ধন করতে বলা হচ্ছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের ফ্যাক্ট-চেকাররা এটিকে একটি সম্ভাব্য প্রতারণা (Scam) সংঘটনের আয়োজন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কেননা, আলোচিত ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করলে দেখা যায় সেখানে প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিম ২০২৪ এর লোগোতে পাকিস্তানের পতাকা ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া, উক্ত ওয়েবসাইটে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের (Shehbaz Sharif) ছবিও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে জানা যায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ২০২৩ সালে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এক লক্ষ ল্যাপটপ প্রদানের একটি স্কিম চালু করেন৷ অর্থাত্ “প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিমে”র আওতায় পাকিস্তানের শিক্ষার্থীরা ল্যাপটপ পাবেন। অথচ, একই স্কিমের নামে বাংলা ভাষায় একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ফ্রি ল্যাপটপের জন্য নিবন্ধন করতে বলা হচ্ছে। ফলে, অনেকেই এটিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক চালুকৃত স্কিম মনে করে ভুল করছেন। বাংলাদেশে প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিম নামে বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের স্কিম চালু হয়েছে কিনা, সে সম্পর্কিত কোন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। ফ্রি ল্যাপটপ পাওয়ার আশায় ওয়েবসাইটটিতে ঢুকে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করার ফলে সেইসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেহাত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোর দাবিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।
অনুসন্ধান:
প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিমের আওতায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ দেয়া হচ্ছে কিনা সেটি যাচাই করতে আমরা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ওয়েবসাইটটি খুঁটিয়ে দেখেছি। ওয়েবসাইটের লিংকে প্রবেশ করলে সেখানে ফ্রি ল্যাপটপের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে একটি ফরম পূরণ করে নিবন্ধন করতে বলা হচ্ছে। আলোচিত লিংকটিতে ঢুকে এর প্রতিটি জিনিস যাচাই করে বেশকিছু অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্রথমত, ওয়েবসাইটের একদম উপরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতিতে ছবিটির উৎস অনুসন্ধান করে আইএনসিপাক এবং বোলনিউজ নামক দুটো পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদ পাওয়া গেছে। উক্ত সংবাদগুলো পড়ে জানা গেছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশকিছু ক্রাইটেরিয়া বা মানদণ্ড পূরণ করার সাপেক্ষে বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের একটি স্কিম চালু করেন। “Prime Minister’s Youth Programme” নামক একটি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেল থেকে গত ৩০ মে ২০২৩ এ একটি পোস্ট শেয়ার করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ল্যাপটপ স্কিমের জন্য আবেদন করার আহ্বান জানানো হয়। উক্ত স্কিমের আওতায় ল্যাপটপ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য নিবন্ধন করতে “Prime Minister’s Laptop Scheme” নামে একটি নিবেদিত ওয়েবসাইটের লিংকও খুঁজে পেয়েছি আমরা, যা দেখতে পারবেন এখানে। বলাবাহুল্য, আমাদের আলোচিত ওয়েবসাইট এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ল্যাপটপ স্কিমের জন্য আবেদন করার ওয়েবসাইটের মাঝে কোন মিল নেই।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ওয়েবসাইটের লিংকটিতে প্রবেশ করে দেখা গেছে সেখানে প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিম ২০২৪ এর লোগোতে পাকিস্তানের পতাকা ব্যবহার করা হয়েছে, যার সাথে পাকিস্তানের প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ প্রোগ্রামের লোগোর বেশ মিল রয়েছে।
তৃতীয়ত, আমাদের আলোচিত ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেস বার থেকে পাওয়া ডোমেইন নেইমটি নিয়ে ‘WhoIs’ নামক একটি ডোমেইন যাচাইকারী ওয়েবসাইট দিয়ে যাচাই করে দেখা গেছে, উক্ত ওয়েবসাইটটি চীনের আন হুই শেঙ (An Hui Sheng) প্রদেশ থেকে “Chengdu West Dimension Digital Technology Co., LTD” নামক একটি কোম্পানির মাধ্যমে গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ রেজিষ্ট্রেশন করা হয়, যার মেয়াদ আগামী ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ এ উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। অন্যদিকে, সরকারি বিভিন্ন সেবাপ্রদানমূলক ওয়েবসাইটগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট ডোমেইন নেইম (bangladesh.gov.bd) থাকে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী “প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিম” নামে বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের কোন স্কিম চালু করেছে কিনা সেটি যাচাই করতে গিয়ে আমরা জানতে পেরেছি যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “Her Power Scheme” এর আওতায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এ সাতক্ষীরা জেলার ২৪০ জন নারী আইটি প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়। তবে, বাংলাদেশে “প্রাইম মিনিস্টার’স ইয়ুথ ল্যাপটপ স্কিম” জাতীয় কোন স্কিমের তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি।
উপরের আলোচনা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, পাকিস্তানের একটি স্কিমের নামে বাংলা ভাষায় ওয়েবসাইট তৈরি করে প্রতারণা সংঘটনের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় তৈরিকৃত ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করে অনেকেই একে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক চালু হওয়া স্কিম বলে ভুল করছেন। ফ্রি-তে ল্যাপটপ পাওয়ার আশায় ওয়েবসাইটে ঢুকে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করার ফলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেহাত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোর দাবিকে বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।