সম্প্রতি “হিন্দুদের বাসায় ও মন্দিরে ভাঙচুর করার পরিকল্পনাকারী কিছু হিন্দু দুর্বৃত্তদের হাতেনাতে ধরা হয়েছে” দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া প্রায় ৩৫ মিনিট দীর্ঘ এই ভিডিওর উপর ভিত্তি করে থ্রেডসেও এই তথ্যটি ছড়ানো হয়। তবে ভিডিও পর্যালোচনা করে মন্দির কিংবা বাসা ভাংচুরের পরিকল্পনা করেছেন এমন হিন্দুদের হাতেনাতে ধরার কোনো প্রমাণ মেলেনি। কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ হবে বলে একটি গুজব ছড়িয়েছিলেন এমন একজন হিন্দুকে ধরা হয়। এই গুজবটি যারা ছড়িয়েছে মূলত তাদের নিয়ে সালিশের ভিডিও এটি। কিন্তু পোস্টদাতা এবং ক্যামেরার পিছনে যে ব্যক্তি কথা বলছিলেন তারা এই বিভ্রান্তিটি ছড়ান।
ভিডিওটির বিবরণ
ভিডিওর শুরুতেই দেখা যায়, একটি কক্ষের মধ্যে অনেকেই আলোচনায় বসেছে। ভিডিওটি একটি ফেসবুক লাইভ। সেখানে ক্যামেরার পিছনে কাউকে কথা বলতে শোনা যায়। তিনি বলেন, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বৈদ্যেরবাজার এলাকায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের মন্দির ভাংচুর এবং হুমকি প্রদানকে কেন্দ্র করে এই সভার আয়োজন করা হয়। আরোও বলা হয় যে জনতা তৎপর থাকায় দুর্বৃত্তদের হাতেনাতে ধরতে পেরেছে। যদিও সম্পূর্ণ ভিডিওতে কোথাও কাউকে হাতেনাতে ধরার প্রমাণ মেলেনি। পরবর্তীতে একজন ব্যক্তি যিনি মন্দির পাহারা দিয়েছিলেন বলে দাবি করছেন তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, তাদের এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় মন্দির এবং বাড়িঘর আক্রমণের বিভিন্ন খবর তার কাছে আসে। যেখানেই কল পেয়েছেন তিনি তাদের পাহারা দিতে ছুটে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি আফসোস করে বলেন, হিন্দুরা একটি পোস্ট করে বিভ্রান্ত করেছে। এখানে কি পোস্ট করা হয়েছে এ বিষয়ে তিনি কোনো ধারণা দিতে পারেননি। পরবর্তীতে ভিডিওর সামনে থাকা এক ব্যক্তি যিনি পরবর্তীতে নিজেকে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য বলে দাবি করেন তিনি ক্যামেরার পিছনে এসে বলেন, কিছু দুর্বৃত্ত হিন্দুরা নিজেদের ঘর নিজেরাই ভেঙে জামায়াত এবং বিএনপির উপর দায় চাপিয়েছে। তিনি আরোও বলেন, উক্ত এলাকায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ তারা প্রতিহত করবেন। পরবর্তীতে ভিডিওর পিছনে থাকা আগের ব্যক্তিটি আবার বলেন যে, তারা গোপন সূত্রে জেনেছেন এই ঘটনার মূল হোতার নাম “সুদীপ/সুজিত চন্দ্র রায়” (কথার অস্পষ্টতার কারণে পরিষ্কার বুঝা যায় নি)। কিছুক্ষণ পরেই এই “মূল হোতাকে” ক্যামেরার সামনে হাজির করা হয়। ভিডিওর এক পর্যায়ে উক্ত ব্যক্তির নাম জানা যায়। তিনি নিজেই তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন তার নাম সুদীপ কুমার রায়। তাকে ক্যামেরার সামনে এনে ঘটনার বিবরণ দিতে ডাকা হয়।
সুদীপ কুমার রায়ের বক্তব্য
তিনি বলেন, এলাকায় একটি মিটিং হয় হিন্দু ছেলেদের নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো, এলাকায় গুজব যেন না ছড়ায়। গুজবে কান না দিতে বাড়ি বাড়ি বার্তাও পৌঁছে দেন তারা। পরে হিন্দু ছেলেদের মোবাইল নাম্বারের একটি তালিকা করা হয়। পরবর্তীতে সবাইকে সমন্বয় করতে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয় এবং যুক্ত করা হয়। সবাই গ্রুপে নিজেদের পরিচয় দেয়। গ্রুপে সুদীপ লিখেন বলেন এলাকায় যাতে কোনো সমস্যা না হয় তাই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। গ্রুপে থাকা একজন বলেন তাদের এলাকায় কয়েকজনের বাড়িতে হামলা হতে পারে। পরে সুদীপ বলেন এমন কোনো তথ্য থাকলে তার প্রমাণ দিতে। এসবের স্ক্রিনশট তার কাছে আছে বলেও জানান তিনি। পরবর্তীতে গ্রুপে এমন অনেকেই এমন তথ্য শেয়ার করতে থাকে। এক পর্যায়ে গ্রুপে বিভিন্নজন বিভিন্নজনকে যুক্ত করতে থাকে এবং সবাই একের পর এক তথ্য দিতে থাকে। অবস্থা এমন দেখে তিনি তার নিজের পরিচয় গ্রুপে দেন এবং বলেন সবাই যেনো যার যার পরিচয় দিয়ে পোস্ট করে। পরবর্তীতে একজন জিজ্ঞেস করে এলাকায় “জামায়াতের কে কে আছে”। তখন সুদীপ বুঝতে পারেন এই গ্রুপের মাধ্যমে যেকোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা হতে পারে। এক পর্যায়ে তিনি গ্রুপের সবাইকে রিমুভ করা শুরু করেন এবং পরে গ্রুপটি বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, গ্রুপে যা কথা হয়েছে তাদের কাছে এর প্রমাণ আছে। তিনি আরও বলেন, গ্রুপে যে তথ্যগুলো সবাই দিচ্ছিলো সেগুলো নিতান্তই গুজব।
এরপর জামায়াতের পরিচয় দেয়া একজন সদস্য বলেন, তারা কখনোই হিন্দুদের উপর আঘাত করবেন না, এলাকায় যদি এমন কখনো হয় তাহলে ধরে নেয়া হবে এই হিন্দু যারা গুজব ছড়িয়েছে তারাই ঘটিয়েছে। এমন কিছু ঘটলে তাদের শাস্তি দেয়ার কথাও তিনি বলেন। পরবর্তীতে উপস্থিত থাকা বিএনপি এবং জামায়তের সদস্যরা তাদের বক্তব্য রাখেন। সবাই মূলত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথাই বলেন। সবসময় হিন্দুদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
শেষে একজন হিন্দু যিনি এই গুজব ছড়িয়েছিলেন তিনি বলেন, তাকে কেউ একজন কল করে জানায় যে কয়েকজনের বাড়িতে আক্রমণ হবে। তাই তিনি উক্ত গ্রুপে এটি সবাইকে জানায় যেনো সবাই সতর্ক থাকতে পারেন। তিনি এক পর্যায়ে এটিও বলেন যে, বিএনপি জামায়াত তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় সার্বিক সহায়তা করেছে। পরবর্তীতে ক্যামেরার পিছনে থাকা ব্যক্তিটি প্রশ্ন করেন যে, এই গুজবে কি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনই যুক্ত কি না, তিনি তা স্বীকার করেন। পরে তিনি গুজব ছড়ানোর জন্য ক্ষমা চান এবং বিষয়টির মীমাংসা হয়। এক পর্যায়ে মিটিংয়ে একজন সেনাবাহিনীর সদস্য আসেন। তার কাছে একজন সম্পূর্ণ ঘটনাটির একটি সারমর্ম বলেন। পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলিম একসাথে থাকার কথা বলে মিটিংটি শেষ হয়।
ঘটনার সারমর্ম
উক্ত এলাকায় গুজব রটানো হয় যে, এলাকার বিভিন্ন হিন্দু বাড়িতে হামলা হবে। যার ফলশ্রুতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপি এবং জামায়াতের অনেক সদস্য তখন রাত জেগে সেখানে পাহারা দেন। পরেরদিন যারা গুজব ছড়িয়েছে তাদের নিয়ে সালিশ বসে এবং বিষয়টির মীমাংসা হয়। ভাইরাল এই ভিডিওটি মূলত উক্ত সালিশের ভিডিও।
ফ্যাক্টওয়াচের বিশ্লেষণ
ভাইরাল ভিডিওটি একটি গুজবকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন হিন্দু বাড়ি আক্রমণ হতে পারে এমন একটি গুজব। গুজব যে ছড়িয়েছে সে একটি ফোনকলের মাধ্যমে এমন তথ্য পেয়েছে বলে জানায়। এই গুজবের প্রেক্ষিতেই যে এটি ছড়িয়েছে তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হয় এবং বিষয়টি মীমাংসা করা হয়। কিন্তু ভিডিওটি যিনি পোস্ট করেছেন এবং যিনি ক্যামেরার পিছনে কথা বলেছেন তিনি একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য সেখানে দেন। তিনি বলেন, হিন্দুরা নিজেরাই নিজেদের বাড়ি এবং মন্দির হামলার পরিকল্পনা করে এবং তাদের হাতেনাতে ধরা হয়। কিন্তু ভিডিওতে কোথাও এমন কোনো পরিকল্পনাকারীকে দেখতে পাওয়া যায় নি। এমনকি যিনি ভিডিওটি করেছেন তিনিও শেষ অংশে এটি বলেন যে, গুজব ছড়ানোর প্রেক্ষিতেই এই সালিশটি হয়। তাই এই তথ্যটি সঠিক নয় যে, হিন্দুরা নিজেদের বাড়ি নিজেরা হামলা করার পরিকল্পনার সময় হাতেনাতে ধরা হয়েছে। ভিডিওটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় সম্পূর্ণ ভিডিওটি না শুনে অনেকেই শুধু ক্যাপশনের উপর ভিত্তি করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, ফ্যাক্টওয়াচ শুধুমাত্র ভাইরাল এই ভিডিও পর্যালোচনা করে উক্ত সিদ্ধান্তটি দিয়েছে। মূলত এলাকায় কি ঘটেছে সেটি সরেজমিনে যাচাই করেনি। তবে যেহেতু, ভিডিওর ক্যাপশন এবং মূল ভিডিওর ঘটনা সাংঘর্ষিক তাই উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল এই থ্রেডস পোস্টকে “বিভ্রান্তিকর” চিহ্নিত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।