বিকৃত মুখমন্ডলের এক যুবকের ছবিসহ আর্থিক সহায়তা চেয়ে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। এসব ছবিতে ওই যুবককে ব্যাটারির এসিড দুর্ঘটনার শিকার দাবি করে তার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখানে যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি ভারতের জনৈক রবিকুমার এর ছবি । তিনি ইতিমধ্যে সূস্থ হয়ে গিয়েছেন । সকল সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিটিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: অস্বাভাবিক মুখমন্ডলের এক যুবকের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে এই নিবন্ধে। এসব বিষয়ে সংবেদনশীল পাঠকদের এই নিবন্ধটি এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বিভ্রান্তিরউৎস
গত ৬ই জুলাই একযোগে বিভিন্ন গ্রুপে এই ছবি এবং পোস্ট শেয়ার করা শুরু হয়। এক্ষেত্রে মারজিয়া রহমানতানিশা আখতার তিশা সহ কয়েকটি আইডি ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী দেড় মাস কোনো ধরনের তথ্যগত পরিবর্তন ছাড়াই একই পোস্ট বারবার বিভিন্ন গ্রুপে এবং পেজ থেকে শেয়ার করা হতে থাকে। এসব পেজে রোগীর সংবেদনশীল ছবি থাকলেও তার স্বাস্থ্যের কোনো আপডেট কিংবা চিকিৎসা সম্পর্কিত কোনো তথ্যই দেওয়া হয়নি।
এই পোস্টে বলা হয়, এই ভাইটি একজন বাকপ্রতিবন্ধী সৎ দরিদ্র রিকশাচালক মনিরুল ইসলাম। পরিবারে অসুস্থ মা সহ ৫ জন সদস্যের মধ্যে মনিরুল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ব্যাটারির এসিডে দগ্ধ মুখ, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, খুব তাড়াতাড়ি সার্জারি না করানো হলে আরো ভয়াবহ অবস্থায় পরিণত হওয়ার কথা ডাক্তার জানিয়েছে এবং চিকিৎসা করতে হলে প্রাই ৫ লক্ষ টাকা দরকার! স্থানীয়ভাবে এলাকাবাসী ও আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে প্রায় ২ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বর্তমানে তার মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছোট ভাই, স্ত্রী ও মেয়ে চিকিৎসার টাকার জন্য সবার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে শুধুমাত্র টাকার অভাবে পরিবারে পক্ষে চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না
তাই আপনারা আসুন একজন দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই, আর্থিক সহযোগিতার হাত বাঁড়াই। সাহায্য করতে না পারলেও দয়া করে পোস্টটি শেয়ার করুন যাতে কোনো দানশীল ব্যক্তির নজরে আসে। আপনার সামান্য একটু মানবিক সহযোগিতায় বেঁচে যাবে একটি পরিবার। মনিরুল বর্তমানে নোয়াখালী সদর হাসপাতালে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসারঅধীনেই আছে ।
(যোগাযোগ ও সাহায্য পাঠানোর মাধ্যম মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম)
বিকাশ পার্সোনাল : 01306313164
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
ভাইরাল হওয়া পোস্টের সাথে বিভিন্ন এ্যাংগেলে রোগীর কয়েকটি ছবি পাওয়া যাচ্ছে। তবে কোনো মেডিকেল প্রেসক্রিপশন, কিংবা হাসপাতালে ভর্তির কাগজপত্র কিংবা ডায়াগনোস্টিক রিপোর্ট এসব ছবির সাথে আপলোড করা হয়নি।
ইমেজ সার্চের মাধ্যমে দেখা গেল, এসব ছবি গত ২৬শে এপ্রিল ভারতের Ketto নামের একটি ফান্ড রেইজিং অর্গানাইজেশনের ফেসবুক পেজ থেকে আপলোড করা হয়েছিল।
এই ছবির ক্যাপশনে বলা হয়, ৪০ বছর বয়স্ক রবিকুমার একটি বিরল রোগে ভুগছেন। তার অপারেশন প্রয়োজন।
ketto এর ওয়েবসাইটে রবিকুমার এর অসুখ সংক্রান্ত কাগজপত্র, ডায়াগনোস্টিক রিপোর্ট এবং ডাক্তারদের মতামত ও দেখা গেল। এখান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সাল থেকে রবিকুমার এর ঠোট এবং চোখের চামড়া অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে। বর্তমানে (এপ্রিল,২০২১) এই বৃদ্ধির পরিমান এত বেড়েছে যে তার চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
পরবর্তীতে ৩রা জুলাই তারিখে ভারতের Richardsons Dental & Craniofacial Hospital এর ফেসবুক পেজ থেকে পুনরায় এই যুবকের পুরনো ছবি, এবং অপারেশনের পরের ছবি প্রকাশ করা হত। ক্যাপশনে বলা হয়, এটি Juvenile Xanthogranuloma নামক বিরল ধরনের মুখের টিউমার। অপারেশনের ৪০ দিন পরের ছবি।
অর্থাৎ, ৩ জুলাই তারিখেই ভারতীয় মিডিয়া যেখানে এই যুবকের সফল অপারেশনের খবর দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে কতিপয় ফেসবুক ব্যবহারকারী একই ছবি ব্যবহার করে তাকে এসিড দুর্ঘটনায় আক্রান্ত বলে দাবী করছে, এবং অর্থ সাহায্য চাইছে।
ভাইরাল পোস্টে যে একাধিক বিকাশ নাম্বার দেওয়ায়া হয়েছে । প্রধান নাম্বারে (01306313164) কয়েকবার ফোন করা হলেও কেউ ফোন ধরেন নি। ফেসবুক পোস্টে এই 01306313164 নাম্বারটাকে রোগীর ছোট ভাইয়ের নাম্বার বলে দাবি করা হয়েছে। তবে গুগল সার্চ করে দেখা গেল, এই একই নাম্বার ব্যবহার করে অতীতেও দেশের ভিন্ন এলাকায় অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়েছে। গত ১৩ই জুন, স্বর্না টেকনোলজিস পেজ থেকে ‘নাটোরের জনি বাচতে চায়’ শিরোনামে যে পোস্ট করা হয়, সেখানেও সাহায্য পাঠানোর জন্য এই 01306313164 নাম্বারটা ব্যবহার করা হয়েছিল।
কথিত রফিকুল ইসলামের অপর একটি বিকাশ নাম্বার 01324004964 অনুসন্ধান করে দেখা গেল, রংপুরের ৩ বছরের শিশুর জন্য সাহায্য চেয়েও এই নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে,এই নাম্বারের মালিক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে শিশু জান্নাত এর বাবা ইসমাইল হোসেন কে। এই 01324004964 এ ফোন করলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ ফোন ধরেন নি।
আরেকটি বিকাশ নাম্বার 01997173252 অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এই নাম্বার ব্যবহার করে শিশু সবুজ এর জন্য সাহায্য চাওয়া হয়েছিল।
এই 01997173252 নাম্বার এ ফোন করলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
গত ১৮ই আগস্ট তারিখে ফ্যাক্টওয়াচে ভারতীয় শিশুর ছবিকে ব্যবহার করে মানবিক সাহায্যের ভুয়া আবেদন শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এখানে ৭ মাস বয়সী এক কল্পিত অসূস্থ শিশুর জন্য সাহায্য চাওয়া হচ্ছিল। উক্ত শিশু ,এবং কথিত এই অটোচালক মনিরুল ইসলামের সাহায্য চাওয়ার দুটো স্ট্যাটাসেই ভাষাগত সাদৃশ্য লক্ষনীয়। বিশেষত, প্রথম অংশ এবং শেষ অংশ হুবহু এক। মাঝের অংশে, অর্থাৎ রোগীর বর্ণনা অংশে ভিন্নতা রয়েছে।
ভারতের সূস্থ হয়ে যাওয়া রোগীর পুরনো ছবিকে বাংলাদেশের নোয়াখালীর অটোচালকের ছবি দাবি করা , এবং যথাযথ তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই মানবিক সাহায্যের আবেদন করার কারনে ফ্যাক্টওয়াচ এই ভাইরাল পোস্ট এবং ছবিকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে। কোনো অসাধু চক্র মানুষের সংবেদনশীলতাকে পুঁজি করে কিছু অর্থ সংগ্রহের আশায় এই বীভৎস ছবিটা ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে ফেক নিউজ তৈরি করেছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?