যা দাবি করা হচ্ছে : ৭দিনের জন্য সকল কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা – এমন দাবিতে ৬ জন সমন্বয়কের সাক্ষরযুক্ত একটি বিবৃতি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধানে যা পাওয়া যাচ্ছে : উক্ত বিবৃতিটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো ফেসবুক পেজ , গ্রুপ বা কোনো সমন্বয়কের প্রোফাইল থেকে পাওয়া যায়নি। বরং সমন্বয়করা ৩ আগস্ট শনিবার শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন এবং ছড়িয়ে পড়া এই বিবৃতিকে ‘ভুয়া’ হিসেবে সনাক্ত করেছেন।
৩রা আগস্ট এর তারিখ সম্বলিত এবং ৬ জন সমন্বয়কের স্বাক্ষর সম্বলিত এই পোস্টে আগামী ৭ দিনের জন্য সকল আন্দোলন প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে , কোনো তারিখ বিহীন ভিন্ন একটা বিবৃতিতে নির্দিষ্ট কোনো সময় বেধে না দিয়ে আজ থেকে সকল আন্দোলন প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে। অনুসন্ধান
তারিখবিহীন বিবৃতিটা নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহ খানেক আগেই এই বিবৃতিটা অনলাইনে দেখা গিয়েছিল। পুরনো কয়েকটি পোস্ট দেখতে পাবেন এখানে, এখানে, এখানে।
কোনো লেটারহেড ছাড়া সাদা কাগজে ছাপানো এই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল- কোটা সংস্কার আন্দোলন ও তার প্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকেই অপ্রত্যাশিতভাবে আহত এবং নিহত হয়েছেন। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ সহ নানা সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আমরা এ সকল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার নিন্দা জানাই এবং সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত বিচারের দাবী জানাচ্ছি। আমাদের প্রধান দাবী ছিল কোটার যৌক্তিত সংস্কার যা ইতিমধ্যে সরকার পুরণ করেছেন। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর আহ্বান জানাই।
সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের কর্মসূচী প্রত্যাহার করছি।
এবং এর নিচে ৬ জন সমন্বয়কের হাতে লেখা নাম এবং স্বাক্ষর ছিল।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত ২৮শে জুলাই তারিখে ডিবি হেফাজতে থেকে সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ক। এই বিবৃতিটা সেই সময়কার বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
অন্যদিকে, ২রা আগস্ট তারিখে গণমাধ্যমে পাঠানো ৬ সমন্বয়কের অপর এক বিবৃতিতে জানানো হয়, উক্ত বিবৃতিটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।
বিবৃতিতে তারা বলেন, আন্দোলন প্রত্যাহারের বিষয়ে তারা বলেন, আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়ককের ভিডিও স্টেটমেন্টটি আমরা স্বেচ্ছায় দেইনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সিদ্ধান্ত ডিবি অফিস থেকে আসতে পারে না। সারাদেশের সকল সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে না। ডিবি অফিসে আমাদের জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও করা হয়। আমাদের ছেড়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে পরিবারকে ডেকে ১৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় এবং মিডিয়ায় মিথ্যা স্টেটমেন্ট দেওয়ানো হয়। আমাদের শিক্ষকরা দেখা করতে আসলে, দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
এই বিবৃতির মাধ্যমে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।
অন্যদিকে শুক্রবার রাত পৌনে আটটার দিকে ফেসবুকে লাইভে এসে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান। এই কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে শনিবার বিক্ষোভ মিছিল এবং রবিবার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন । শুক্রবার রাত পৌনে আটটার দিকে ফেসবুকে লাইভে এসে এই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান। অন্যন্য সমন্বয়কেরাও নিজেদের প্রফাইল থেকে আন্দোলনের এই কর্মসূচীর কথা জানান, এবং তাদের উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গনমাধ্যম এই নতুন কর্মসূচীর খবর জানাতে থাকে।
৩রা আগস্ট সকাল থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে ৩রা আগস্ট এর তারিখ সম্বলিত একটি লিখিত বিবৃতিতে ৭ দিনের সময়সূচী বেধে দিয়ে বর্তমানে সকল আন্দোলনের কর্মসূচী স্থগিতের কথা জানানো হয়। তবে ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়কের ফেসবুক একাউন্ট থেকে এই বিবৃতিটি দেখা যায়নি। বরং অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এর পেজ , এবং মো. সারজিস আলম ও রিফাত রশিদ এর প্রফাইল থেকে ৩ আগস্ট সকালেও নতুন কর্মসূচির সপক্ষে পোস্ট করতে দেখা গিয়েছে।
শনিবার ৩রা আগস্ট সকাল ৭ টা ১৮ মিনিটে অন্যতম সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ( অফিসিয়াল গ্রুপ) নামক ফেসবুক গ্রুপে ১৫৮ বিশিষ্ট নতুন সমন্বয়ক টিম এর একটি তালিকা শেয়ার করেন। এখানে ৪৯ জন সমন্বয়ক এবং ১০৯ জন সহ-সমন্বয়ক রয়েছে। এখানে যে লেটারপ্যাড ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁর সাথে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষনা দেওয়া বিবৃতিযুক্ত লেটারপ্যাডের অমিল রয়েছে। মূল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্যাডে কোনো লোগো বা মনোগ্রাম নেই, কিন্তু আজ ভাইরাল হওয়া আন্দোলনে প্রত্যাহারের বিবৃতির প্যাডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো রয়েছে, যা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর অফিসিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেলে আজ সকাল ১১টা ৪৯ মিনিটে একটি পোস্টের মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে ছড়িয়ে পড়া বিবৃতিটি ভুয়া।
এই আন্দোলনের অন্যতম একজন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘এটা ভুয়া, এমন কোনো বিবৃতি আমরা দেইনি। এটা এডিটেড, কেউ বিভ্রান্ত হবেন না।’
বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহও একটা ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। সেখানে ‘আন্দোলন নষ্ট করার জন্য ভুয়া বিবৃতি প্রচার করা হচ্ছে’ বলে জানান তিনি।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ফেইসবুক আইডি থেকে ভিডিও বার্তায় বলেন, “এখন যে আন্দোলন হচ্ছে এটা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সকল শ্রেণি পেশার আন্দোলন। এ আন্দোলন নষ্ট করার জন্য আমাদের সিগনেচার নকল করে ভুয়া বিবৃতি প্রচার করা হচ্ছে। একজন, দুজন বা ৫ জন সমন্বয়কে এ আন্দোলন স্থগিত হবে না। আমি হাসনাত আব্দুল্লাহ যদি কখনো দেখেন আন্দোলন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছি ধরে নেবেন এটা আমাকে জোর করে বলানো হয়েছে। জোর করে সে বক্তব্য দেওয়ানো হচ্ছে। সুদিন আশা পর্যন্ত আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।”
সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই সকল পোস্টকে ‘মিথ্যা’ হিসেবে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।