পারিবারিক ছবিকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া চার বান্ধবীর ছবি দাবি

175
পারিবারিক ছবিকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া চার বান্ধবীর ছবি দাবি
পারিবারিক ছবিকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া চার বান্ধবীর ছবি দাবি

Published on: [post_published]

সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে পাশাপাশি দুটো ছবি ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। ছবিটি চারজন নারীর। দাবি করা হচ্ছে, একটি ছবি ১৯৭১ সালের। তখন তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সে সময় বন্দুক হাতে খোলা জিপগাড়িতে ছবিটি তুলেছিলেন। পরবর্তীতে বর্তমান সময়ে এই ভঙ্গিতে বসে পুননির্মাণ করেছেন। পুরানো ছবির পোজে নতুন ছবি তোলা এবং দুটো ছবি পাশাপাশি শেয়ার করার ধরনটি সামাজিক মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়। তবে ছবি দুটোর বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ছবিতে থাকা নারীরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এর পেছনের কাহিনীটি খোলাসা করেছেন। সাদাকালো ছবিতে নারীরা কোন এক শিকার থেকে ফেরার পরে বন্দুক হাতে নিয়ে খোলা জিপগাড়িতে বসে ছবিটি তুলেছিলেন। তারা সবাই মানিকগঞ্জের জাহাজ ব্যবসায়ী শামসুদ্দীন আহমেদের মেয়ে এবং ছেলের বউ। শামসুদ্দীন আহমেদ প্রায়ই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শিকারে যেতেন। ছবিটিতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে যিনি বসে আছেন তার নাম আয়েশা রহমান৷ তার ছেলে শামসুল মুলক ২০২১ সালে প্রথম আলোকে জানান যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার মা আয়েশা রহমান ইংল্যান্ডে ছিলেন। ২০১৫ বা ২০১৭ সালের দিকে সাদাকালো ছবির ঐ চার নারী পারিবারিক অনুষ্ঠানে মিলিত হলে পুরানো ছবিটির আদলে নতুন রঙিন ছবিটি তোলা হয়েছিল। দুটো ছবিতে জিপগাড়ির সামনের আসনে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকা আয়েশা রহমানের পাশে বসে আছেন তার ভাইয়ের বউ রোকেয়া আহমেদ। রোকেয়া আহমেদ মারা গেছেন ২০২০ সালে। ফলে রঙিন ছবিটি কোনভাবেই ২০২১ সালে তোলা হয়নি৷ এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, সাদাকালো ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা হয়নি এবং রঙিন ছবিটিও ২০২১ সালের নয়। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে প্রচারিত দুটো ছবির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিকে “মিথ্যা” সাব্যস্ত করেছে। দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন এবং ইন্টারনেট থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণাদির উপর ভিত্তি করে বর্তমান ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন মোহাম্মদ আরাফাত।

 

অনুসন্ধান:

ফেসবুকে “বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র” নামক একটি পাবলিক গ্রুপ থেকে আমরা প্রথম এই মিথ্যা দাবি সংবলিত পোস্টগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হই। বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র নামক গ্রুপটি বাংলাদেশ এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য এবং ঐতিহাসিক ছবি উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ সহকারে প্রচার করে। আমাদের আলোচিত সাদাকালো এবং রঙিন ছবি দুটো নিয়ে ঐ গ্রুপের একটি পোস্টের বক্তব্য ছিল যে, ছবিতে থাকা চারজন নারী বান্ধবী নন এবং তাদের এই ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা হয়নি৷ তাছাড়া, ভুয়া পোস্টগুলোতে সূত্র হিসেবে BBC News এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা৷ ছবিটি ষাটের দশকের কোন একসময় তোলা হয়েছিল এবং পূ্র্বেও বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র সঠিক তথ্যসহ সেটা প্রচার করেছে। ছবিতে যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের পরিবারও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷ 

মিথ্যা দাবি সংবলিত ছবিটি যারা যারা শেয়ার করেছেন তাদের কিছু পোস্টের নমুনা এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে দেখতে পারবেন।

এই বিষয়টি নিয়ে আরও অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দৈনিক প্রথম আলোর ভাইরাল দুই ছবি, নেপথ্যে ভিন্ন গল্প শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই, যা ২০২১ সালের ৩১ মার্চে প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ প্রতিবেদন অনুযায়ী সাদাকালো এবং রঙিন ছবি দুটোতে যাদের দেখা যাচ্ছে তারা মানিকগঞ্জের জাহাজ-ব্যবসায়ী শামসুদ্দীন আহমেদের মেয়ে এবং ছেলের বউ। শামসুদ্দীন আহমেদের শিকারের নেশা ছিল এবং কোন এক শিকার থেকে ফেরার পরই তার মেয়ে এবং ছেলের বউরা বন্দুক হাতে নিয়ে জিপগাড়িতে উঠে পড়েন ছবি তোলার জন্য। পরবর্তীতে ২০১৫ কি ২০১৭ সালের দিকে ঐ ছবির চারজন নারী — যারা সম্পর্কে ননদ-ভাবী — একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে একত্রিত হয়ে পুরানো ছবিটির আদলে আরেকটি ছবি তুলেন। মূলত এই দুটো ছবিকেই জোড়া লাগিয়ে ফেসবুকে মিথ্যা দাবি সংবলিত পোস্টগুলো প্রচার করা হচ্ছে। শামসুদ্দীন আহমেদের ছেলে আলাউদ্দীন আহমেদ এবং তার ছেলের বউ রোকেয়া আহমেদের ছেলে আমিন উদ্দিন আহমেদ এবং তার স্ত্রী রিফাত আহমেদ বিষয়গুলো খোলাসা করেন প্রথম আলোর কাছে। শামসুদ্দীন আহমেদের নাতি আমিন উদ্দীন আহমেদের বাসায় তার মা এবং চাচিদের সেই সাদাকালো ছবিটি এখনও বাঁধাই করে পারিবারিক স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয়া হয়েছে। নিজের মা-চাচিদের ছবি নিয়ে ভূয়া ফেসবুক পোস্ট নিয়ে আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, “কোনোভাবেই এটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি নয়। পারিবারিক একটি ছবি। প্রথম ছবির মতো করে দ্বিতীয়বার ছবি তুলতে গিয়ে বন্দুক নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। আমার লাইসেন্স করা বন্দুক একজনের হাতে দিই। আর একজনের হাতে একটি স্টিক ধরিয়ে দিই।” 

দুটো ছবির ঐ চারজন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন – এমন বিব্রতকর দাবি ছাড়াও অনেকে তাদেরকে নিজের পরিবারের সদস্য বলে দাবি করেছেন৷ এই বিষয়ে আমিন উদ্দীনের ছেলে রেনান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, “শুধু ছবি নিয়ে বিতর্কই নয়, ফেসবুকে অনেকেই নিজেদের এই চারজনের স্বজন দাবি করছেন তাও সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়।”

সাদাকালো ছবিটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা হয়েছিল কিনা সেটা জানা গেছে ঐ ছবিতে যিনি জিপগাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন সেই আয়েশা রহমানের ছেলে শামসুল মুলকের কাছ থেকে। তিনি জানান, তার মা আয়েশা রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ছিলেন না। তখন তিনি ছেলেমেয়েদের কাছে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন৷ ফলে এটা ১৯৭১ সালের ছবি নয়

দুটো ছবিতেই আয়েশা রহমানের হাতের ডানদিকে বসে ছিলেন তার ভাইয়ের বউ রোকেয়া আহমেদ। রোকেয়া আহমেদ আমিন উদ্দীন আহমেদের মা। আমিন উদ্দীন জানান তার মা ২০২০ সালে ৭৮ বছর বয়সে মারা যান। ফলে যারা দাবি করছেন রঙিন ছবিটি ২০২১ সালের, তাদের দাবি সঠিক নয়।

মিথ্যা দাবি সংবলিত ছবি দুটো ফেসবুকে যারা বিশ্বাস থেকে শেয়ার করেছেন, তাদের চিন্তা করার প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা একটু পর্যবেক্ষণ করেছি। প্রথমত, ছবির নারীরা যে শিকারে গিয়েছেন বা যেতে পারেন এটা কারও চিন্তায় আসেনি৷ তাদের কাছে, বন্দুকসহ নারীদের এমন চিত্র কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়েই সম্ভব মনে হয়েছেকারণ আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধে অনেক নারীও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখন আমরা কনফারমেশন বায়াস নামে একটি প্রবণতা নিয়ে কিছু বলবো। এই পক্ষপাতদুষ্ট লোকেরা কোন কিছু ঘটলে বা নতুন কিছু দেখলে সেটাকে তাদের আগে থেকে বিদ্যমান বিশ্বাস এবং পূর্বধারণা দিয়ে বিচার করা শুরু করে। এটি যখন প্রবল হয়, তখন মানুষ এর ব্যতিক্রম কোন সম্ভাবনা বা ঘটনা সংঘটনের চিন্তা করতে পারে না বা করতে চায় না৷ এটাকেই কনফারমেশন বায়াস বলা হয় মূলত এই প্রবণতা থেকেই ফেসবুকে প্রচারিত ছবি দুটো দাবিকে মানুষ সরল মনে বিশ্বাস করে ফেলে

উপরের বিস্তর আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে ফেসবুকে জোড়া লাগানো দুটো ছবির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিটি সঠিক নয়৷ 

তাই সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ ঐ ছবিগুলোর দাবিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

No Factcheck schema data available.