ফেসবুকে যা ছড়াচ্ছেঃ দুইটি ছবির কোলাজ শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, এগুলো ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে বানানো টিপাইমুখ বাঁধের ছবি।
আসল ঘটনাঃ দাবিটি মিথ্যা। বাস্তবে প্রথম ছবিটি শ্রীলঙ্কার ভিক্টোরিয়া বাঁধের ছবি। আর দ্বিতীয় ছবিতে কোনো একটি নদীর মানচিত্রের ছবিতে সম্পাদনা করে বাঁধের একটি ক্লিপআর্ট বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, টিপাইমুখ বাঁধ এখনও নির্মাণ করা হয়নি। এটি প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র।
টিপাইমুখ বাঁধ হচ্ছে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর একটি প্রস্তাবিত বাঁধ। বরাক নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বাঁধ প্রস্তাবিত হয়েছিল। এই বরাক নদীই দুই ভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরবর্তীতে এদের মিলিত ধারা মেঘনা নাম ধারণ করে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন পাওয়ার পরে বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যে পানিবন্টনজনিত ঝামেলা দেখা দেয়। পাশাপাশি, বাঁধের জন্য সেখানকার কিছু আদিবাসী মানুষদের পুনর্বাসন এবং পরিবেশের হুমকি সম্পর্কিত সমস্যা দেখা দেয়ার কারণে বাঁধ নির্মাণ এখনও শুরুই করা হয়নি।
কিন্তু, ফেসবুকে দুইটি ছবির কোলাজ শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, এগুলো ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর বানানো টিপাইমুখ বাঁধের ছবি!ভাইরাল প্রথম ছবিটি পুর্নাঙ্গ একটি বাঁধের ছবি আর দ্বিতীয়টি একটি বাঁধের মানচিত্রের ছবি। এই মানচিত্রকে টিপাইমুখ বাঁধের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুরুতেই ছবি দুইটি বিশ্লেষণ করে দেখে ফ্যাক্টওয়াচ টিম। কিন্তু দুই ছবিতে বাঁধের গঠনগত আকৃতির কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
ছবিগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এগুলো ব্যবহার করে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধান করা হয়। টিপাইমুখ বাঁধের নামে ভাইরাল ছবিগুলো সম্পর্কে ফ্যাক্টওয়াচের গবেষণা থেকে নিম্নোক্ত তথ্য জানা গেছে:
ছবি ১- ইন্টারনেট ফটো লাইব্রেরী সাটারস্টক এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে একটি বাঁধের ছবি খুঁজে পাওয়া যায় যার সাথে এই বাঁধের ছবিটির বেশ কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন, বাঁধের আকৃতি এবং চারপাশের পরিবেশ। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে, ছবিটি শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া বাঁধের ছবি। পাশাপাশি, শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যম হিরু নিউজের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভাইরাল এই ছবিটির অনুরূপ একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ভিক্টোরিয়া বাঁধ শ্রীলঙ্কার জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ হিসাবে ১৯৮৫ সালের দেশটির মহাবেলি নদীর উপরে নির্মিত হয়েছিল। সেচ এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধটি বানানো হয়েছিল।
গুগল আর্থের ফটোস্ফিয়ারের মাধ্যমেও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া প্রথম ছবিটি শ্রীলঙ্কার ভিক্টোরিয়া বাঁধের। ফটোস্ফিয়ারের মাধ্যমে পাওয়া ভিক্টোরিয়া বাঁধের ছবির গঠনগত আকৃতি এবং আশপাশের পরিবেশের সাথে হুবহু মিল পাওয়া যায়।
ছবি ২– এই ছবিটি কোনো পাহাড়ি নদীর মানচিত্রের, যেখানে বাঁধের একটি ক্লিপআর্ট সম্পাদনা করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পিএনজিট্রি নামের একটি ক্লিপআর্ট লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে বাঁধের এই ক্লিপআর্টটি খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, দ্বিতীয় ছবিতে দেখানো বাঁধটিও বাস্তব নয়।
উল্লেখ্য, টিপাইমুখ বাঁধের ছবি দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এবং উইকিপিডিয়ায় একটি বাঁধের ছবি দেখতে পাওাযায়। কিন্তু, বাঁধটি মূলত ভারতের হিমাচল প্রদেশের চাম্বা অঞ্চলে রাভি নদীর উপর নির্মিত চামেরা বাঁধের। আবার শ্রীলংকার ভিক্টোরিয়া বাঁধের ছবিকে ভারতের কেরালায় অবস্থিত তিনটি বাঁধ দ্বারা গঠিত ইডুক্কি (Idukki) জলধারার একটি বাঁধ ইডুক্কি বাঁধের ছবি বলেও দাবি করা হয়। চেরুথোনি(Cheruthoni)এবং কুলামাভু(Kulamavu) হচ্ছে জলধারাটির অন্য দুইটি বাঁধ।
অন্যদিকে, বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধের সত্যিই কোনো অস্তিত্ব আছে কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য গুগল ম্যাপ এবং গুগল আর্থের সাহায্য নেয়া হয়। গুগল ম্যাপ এবং গুগল আর্থের সাহায্যে নদীটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অংশের স্যাটেলাইট ভিউ দেখা হয়। কিন্তু কোথাও এই নদীর উপর নির্মিত কোনো বাঁধ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেবল নদীটির যেই স্থানে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দেয়া আছে, তার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে কোনো বাঁধের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।