ব্যঙ্গ কিংবা সেলিব্রেটিদের নামে ছড়ানো ভূয়া মন্তব্যগুলো চিনবেন কিভাবে?

77
ব্যঙ্গ কিংবা সেলিব্রেটিদের নামে ছড়ানো ভূয়া মন্তব্যগুলো চিনবেন কিভাবে?
ব্যঙ্গ কিংবা সেলিব্রেটিদের নামে ছড়ানো ভূয়া মন্তব্যগুলো চিনবেন কিভাবে?

Published on: [post_published]

সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত’র নামে বিভিন্ন মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, শান্ত এমন কোনো মন্তব্য করেন নি। মূলধারার গণমাধ্যমে কিংবা সাম্প্রতিক কোনো সংবাদ সম্মেলনে এমন কোনো মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় নি। এছাড়া মন্তব্যগুলো খেয়াল করলে বুঝা যায় এগুলো না বলাটাই স্বাভাবিক। মূলত আমেরিকার বিপরীতে বাংলাদেশের আশানুরূপ পারফরমেন্স না থাকায় অনেকেই দলটিকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় অধিনায়কের নামে বিভিন্ন উক্তি ছড়াচ্ছেন। কিন্তু অনেকেই ঠাট্টার বিষয়টি ধরতে না পেরে সেটিকে সত্যি ভেবে নিচ্ছেন। এসব ভুয়া মন্তব্য চেনার বিভিন্ন উপায় নিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন শুভাশীষ দীপ এবং জহিরুল ইসলাম।

 

নাজমুল হোসেন শান্ত’র নামে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি উক্তি:

১। বাংলাদেশ কেনো আমেরিকার সাথে হেরেছে এই প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে তিনি বলেছেন, “আমেরিকার টিমে ছয় টা দেশ থেকে আসা প্লেয়াররা খেলে। তারা যখন খেলে, ওই ছয় দেশের মানুষই তাদের জন্য দোয়া করে। স্বাভাবিকভাবেই, তারা আমাদের চেয়ে বেশি দোয়া পায়।” 

২। “গুজব ঘর” নামে একটি স্যাটায়ার পেজ থেকে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “মুসল্লীরা আমাদের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করতে মসজিদে যায়। কিন্তু ওই ছাত্রী হোস্টেলের আপুরা ৪-৫ তলার ব্যালকনিতে তাদের পার্সোনাল কাপড় ঝুলায়ে রাখে! এটা দেখে মুসল্লীদের দোয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, এরকম চলতে থাকলে ক্যামনে জিতব ভাই?”

৩। বিভিন্ন মিম এর বিপরীতে শান্তকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হচ্ছে, “লেট মি বি অনেস্ট, আপনারা এসব আজাইরা মিম-টিম এ যে এফোর্ট দেন ওটা আমরা মাঠেও দিই না। শুধু শুধু এসব বানিয়ে কি মজা পান?”

৪। এবং ফ্যাক্ট-চেকারদের উদ্দেশ্যে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, “বাংলাদেশের দর্শকরা স্যাটায়ার বুঝে না। এরা ক্রিকেট কী বুঝবে? এদের এসব আচরণের জন্যেই জিতি না। এবার আয় তোরা ফ্যাক্ট চেক কইরা যা, আয়!”

এসব মন্তব্য দেখে অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন এগুলো পরিষ্কার “সার্কাজম” বা ঠাট্টা। ফ্যাক্ট-চেকারদেরকে অনেকেই বলেন এগুলো ফ্যাক্টচেক করার দরকারই বা কি! কিন্তু সাধারণ মানুষদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা এসব মন্তব্যকে বিশ্বাস করেন। নিচের ছবিতে উপরোক্ত বিভিন্ন মন্তব্যের বিপরীতে মানুষের প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি নমুনা দেয়া হয়েছে। যা দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কিভাবে একটি ভুয়া উক্তি মানুষ শুধু বিশ্বাসই করছে না বরং এর উপর ভিত্তি করে শান্ত’র উপর রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

শুধু তাই না, বেশি দোয়া পাওয়ার মন্তব্যটির উপর ভিত্তি করে রীতিমত ফেসবুক লাইভে এসে সমালোচনা করছেন অনেকেই। “Azadventures” নামের একজন ব্লগারের একটি ভিডিও দেখুন এখানে

সেলিব্রেটিদের নামে ছড়িয়ে পড়া এসব উক্তি যাচাই করার সহজ কয়েকটি উপায় রয়েছে। এগুলো মাথায় রাখলে বিভ্রান্ত হওয়া থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যাবে।

উপায় ১:

যখন এমন ধরনের একটি উক্তি সামনে আসবে তখন তার সোর্স খুঁজে বের করাটা বেশি জরুরি। ইদানীং ফটোকার্ড আকারেই উক্তিগুলো বেশি ছড়াচ্ছে। এসব ফটোকার্ডে সাধারত উদ্ধৃত সেলিব্রেটির একটি ছবি আর তার উক্তি দেয়া থাকে। সেই সাথে গণমাধ্যমের নাম/প্রতিষ্ঠানের নাম,তারিখ ইত্যাদি তথ্য থাকে। এক সাইডে স্পন্সরের বিজ্ঞাপন ও থাকতে পারে।

নিচের ফটোকার্ডে দেখুন, উপরে বামপাশে ডেইলি ক্রিকেট এর নাম দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ এটি ডেইলি ক্রিকেট নামের একটি গণমাধ্যম থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ডেইলি ক্রিকেট এর ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুক পেজে গেলে মূল পোস্ট টি খুঁজে পাবেন। 

ডেইলি ক্রিকেট যেহেতু কোনো স্যাটায়ার ওয়েবসাইট না, অর্থাৎ আসল খবরই ছাপায়, তাই এসব সূত্র থেকে ভুয়া উক্তি ছড়ানোর সম্ভাবনাও কম।

নিচের এই ছবিটি দেখুন, এখানে এক কোনায় “গুজব ঘর” এর নাম রয়েছে। “গুজব ঘর” এর ফেসবুক পেজ ঘেঁটে বুঝতে পারবেন, এটি একটি স্যাটায়ার পেজ। এই ক্যাটাগরির পেজগুলো সাধারণত মজা করার উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন পোস্ট করে থাকে। তাই ধরেই রাখতে হবে এ ধরণের সূত্র থেকে যে উক্তিগুলো ছড়ানো হয় সেগুলো সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। 

নিচের ছবি দুইটি লক্ষ্য করলে দেখতে পারবেন এখানে প্রকাশক কিংবা কোনো গণমাধ্যমের লোগো বা নাম নেই। এই ধরণের ফটোকার্ডই মূলত বিভ্রান্তি তৈরি করে। অনেকেই বুঝতে পারেন না এটি সত্য না কি মিথ্যা। সূত্রহীন এসব ফটোকার্ডকে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। ধরেই নিতে হবে এগুলো ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।


 

উপায় ২:

সেলিব্রেটির নামে যে উক্তিটা ভাইরাল হয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ বা আংশিক কপি করে ফেসবুক, গুগল অথবা ইউটিউবে অনুসন্ধান করুন। লক্ষ্য করুন কোথায় কোথায় এই উক্তিটা দেখা যাচ্ছে, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি। আনভেরিফাইড পেজের চেয়ে ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ বেশি নির্ভরযোগ্য, আবার ফেসবুক পেজের চেয়ে ওয়েবসাইট বেশি নির্ভরযোগ্য, আবার “লুতুপুতু ডট কম” এর মত ওয়েবসাইটের চেয়ে প্রথম আলোর মত গণমাধ্যম বেশি নির্ভরযোগ্য। এভাবে ধাপে ধাপে একটি সূত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

 

অনুসন্ধানের সময় আরোও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে:

১। কোনো ফেসবুক পেজে এক/দুই লাইনের বক্তব্যের উপর নির্ভর না করে, ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সম্পূর্ণ খবর বা সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়তে হবে।

২। শুধুমাত্র ফেসবুকে/ইউটিউবে উক্তিটা আছে, কিন্তু কোনো ওয়েবসাইটে নাই – এমন পরিস্থিতিতে ধরে নিতে হবে যে তিনি এমন কথা বলেন নি। 

৩। এছাড়া, আমাদের অনুসন্ধানকে কিছুটা ফিল্টার করে পুরনো কোনো পোস্ট বা প্রতিবেদন পাওয়া যায় কি না সেটি খুঁজে বের করতে হবে। পুরনো পোস্ট পাওয়া গেলে বুঝতে পারবেন, তিনি সম্প্রতি এই কথা বলেন নি বরং অনেক আগে (হতে পারে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে) এই কথা বলেছিলেন। 

 

উপায় ৩: 

কোনো সেলিব্রেটি এই ধরণের মন্তব্য করেছেন কি না সেটি যাচাই করতে তার নিজস্ব ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ/ ইন্সটাগ্রাম /ইউটিউব একাউন্ট থেকে চেক করতে পারেন।

 

উপায় ৪:

এক/দুই লাইন বক্তব্যে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।  এক্ষেত্রে সেলিব্রেটির পুরা বক্তব্য অডিও/ভিডিও আকারে শুনলে ঘটনা পরিষ্কার হয়। ইউটিউবে খবরের মধ্যে, কিংবা প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা উক্ত ঘটনার সম্পূর্ণ স্ট্রিমিং এ সম্পূর্ণ বক্তব্য পাওয়া যেতে পারে। তাই সবসময় উক্তিটির প্রেক্ষাপট জেনে নেয়াটা জরুরি, কোন প্রশ্নের বিপরীতে উক্তিটি করা হয়েছে সে বিষয়ে ধারণা পেলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যায়।

 

উপায় ৫:

মূল সেলিব্রেটির কাছে জানতে চাওয়া যে তিনি এই কথা বলেছেন কিনা। তবে এটা প্রধাত সাংবাদিকদের কাজ। সাধারণ মানুষের জন্য তাদের পর্যন্ত পৌঁছানো সহজ কাজ নয়। আর তাছাড়া, বিতর্কিত কোনো উক্তি হলে অনেকসময় নিজের মন্তব্যকে অস্বীকারও করতে পারেন। অতীতে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। 

 

অর্থাৎ, কোনো উক্তি সত্য না মিথ্যা সেটি যাচাই না করে বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। ফ্যাক্টচেকারদের দৃষ্টিকোণ থেকে উপরে কয়েকটি পদক্ষেপ আলোচনা করা হলো যার মাধ্যমে সাধারণ পাঠকরা খুব সহজেই একটি উক্তি যাচাই করতে পারেন, কিন্তু এর বাইরেও অনেক উপায় থাকতে পারে। মূল বিষয়টি যেকোনো উপায়ে একটি উক্তি যাচাই করা এবং এর ভিত্তিতে সেটি আরেকজনের কাছে শেয়ার করা।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

No Factcheck schema data available.